সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
৮৫ দিনের অধিক সময়কালীন সময়ের রাজনৈতিক সহিংসতা, পেট্রলবোমা আর ক্রস ফায়ারের ভয়াবহ সংকটজনক অবস্থা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি যখন সিটি নির্বাচন কেন্দ্রিক কিছুটা স্বস্থি এবং আশার আলোর বার্তা নিয়ে এসেছে, অর্থাৎ রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক জীবনে যখন কিছুটা হলেও ভীতিকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে একটু প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, তখনি কেন সরকার প্রশাসন হুট করে তারেক রহমানের উপর ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট জারি করলো ? প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবে আসতেই পারে । কেননা সরকার যেখানে দেশের শান্তি- শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুরো শক্তি প্রয়োগ করে নাস্তানাবুদ অবস্থায় ছিলো- সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে সরকারের জন্য , দেশের জন্য, জনগনের জন্য একটু স্বস্থি, শান্তি নিয়ে এসেছে- তখন সরকার ইচ্ছে করেই কেন সেই শান্তিময় পরিবেশে বিষের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে- এমন প্রশ্ন অনেকেই করছেন। সরকারকি আদৌ তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে নিতে চায় ? নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তারেক ট্র্যাম্প কার্ড ব্যবহার করতে চায় রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন টার্নিং পয়েন্টে ? নাকি স্রেফ রাজনীতির মাঠে ফায়দা লুটার জন্য এবং বিএনপিকে চাপের মধ্যে রেখে নিজেদের ঘরে ফসল তুলতে চায় ? কেননা সরকার জানে, তাবত বিশ্ব জানে তারেক রহমান লন্ডনে আছেন। প্রকাশ্যে ঘুরছেন, বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। তাহলে রেড-এলার্ট জারি করানোর মানে কি?
৮৫ দিনের উপরেও সন্ত্রাস ও অরাজনৈতিক কর্মকান্ড উসকে দিয়ে বিএনপি যে খুব সুবিধা জনক অবস্থানে নেই সরকার সেটা ভালো করেই জানে। সন্দেহ নাই, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন নাজুক অবস্থায় আর পড়ে নাই। একের পর এক ভুল চাল আর কৌশল সেই সাথে তারেক রহমানের উচ্চাভিলাষী অরাজনৈতিক বক্তব্য বিবৃতি বিএনপিকে আজ নাজুক এক অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আশার কথা অনেক অনেক দেরীতে হলেও খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান বুঝতে পেরেছেন রাজনীতিতে সব সময় একই চালের খেলা খেলে সফল হওয়া যায়না।
সরকার জানে, তারেক রহমান লন্ডনে এবং প্রকাশ্যে রাজনৈতিক জনসভায় বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার সব কিছু জেনে শুনেই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য যেমন এমন কাজ করছে, একই সাথে ঢাকার রাজনীতিতে খালেদা জিয়াকে চাপে রেখে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ২০১০ সালের আদলে অথচ রাজনৈতিক লেবেল লাগিয়ে, বিএনপির অংশ গ্রহণের সার্টিফিকেট তকমা জুড়ে দিয়ে এককভাবে নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীদের জয়ী করে আনতে চায়। ইতোমধ্যেই নানা আইনী জটিলতায় বিএনপির প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় নামার সুযোগ স্বল্প মাত্রায় নিয়ে এসেছে। তারপরেও দ্বিতীয় যে চিন্তা সরকারের তাহলো রেড এলার্টের মাধ্যমে সরকার বিশ্ব জনমতকে নিজের দিকে ঘুরাতে চায়। সরকার প্রমাণ করতে চায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপির আগামী নেতৃত্ব অনেক ঝুকিপূর্ণ। কেননা এতোটাই ঝুকিপূর্ণ যে, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তারেক রহমানের নামে রেড এলার্ট ইতোমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে। সাম্প্রতিক হরতাল অবরোধের সময় আওয়ামীলীগের সরকার আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে বেগম জিয়াকে সন্ত্রাসের ইন্ধন দাতা, ইসিলামিক কট্রর গোষ্ঠীদের মদদকারী হিসেবে প্রমাণের চেষ্ঠা সকলেই অবগত। এহেনও অবস্থায় সরকার জানে, আগামী ২০১৯ সালের অথবা এর কিছু আগে নির্বাচন দিলে বিএনপি অন্যান্য ছোট ছোট দলের সাথে ঘাট বেধে নির্বাচনে নামবে। অনুকূল পরিবেশে তারেক রহমান তখন দেশে ফেরার উদ্যোগ নিবেন। সরকার আন্তর্জাতিক মুরুব্বী এবং দাতাদের কাছে তারেক প্রশ্নে রিজার্ভেশন করার সুযোগ তৈরি আইনগতভাবেই করে রাখলো। এছাড়াও তারেক রহমান যাতে আগামী বছরের দিকে আর কোন এক্সট্রিম আন্দোলনের ডাক দিতে না পারেন- সরকার সেই হিসেব সামনে নিয়েই এগুচ্ছে।
ইন্টারপোলের কর্ম পরিধি এবং কর্ম নিয়ে নিজেদের যে নিয়মাবলী রয়েছে, তাতে যেমন রাজনৈতিক নেতা বা প্রধান, ধর্মীয় নেতা ইত্যাদির প্রশ্নে এরকম এলার্ট জারি থেকে বিরত থাকার বিধান রয়েছে (আর্টিক্যল তিন ধারায় রয়েছে)। ইন্টারপোল সেই বিধান এ ক্ষেত্রে পালন না করায়, যে দেশে এর সদর দপ্তর এবং যে সব দেশের বাজেটে এই ইন্টারপোল পরিচালিত হয়ে থাকে, সেই সব দেশের নমনীয় ভুমিকা যে এক্ষেত্রে কাজ করেছে সরকারের অনুরোধে- এমন রেড এলার্ট সেটাই প্রমাণ করে।ইউরোপ প্রশ্নে ব্রিটেনের সাথে সদস্য দেশসমূহের টানা পোড়েন চলছে। সামনে নির্বাচন। ইন্টারপোলের সদর দপ্তরের সদস্য দেশের সরকারের সম্মতি এই সুযোগে ব্রিটেনের অবস্থানের ব্যাপারে বার্গেনিং পয়েন্ট ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইউরোপীয় দেশ সমূহের মধ্যেও একটা নাভিশ্বাস তারেক ইস্যু কেন্দ্রিক সুযোগের ব্যবহার বৈ আর কিছু নয়। কেননা তাবত পৃথিবী জানে ব্রিটেন যাকে আশ্রয় দেয়, তাকে অনেক ভেবে চিনতে এবং সুদূঢ় প্রসারী এক পরিকল্পণা এবং লাভালাভ হিসেব নিকেশ করেই দেয়। বিশ্বও ব্রিটেনের এমন পলিসির ব্যাপারে গত বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালীন থেকে অবগত হেতু ব্রিটেনে আশ্রয়ে থাকা রাজনৈতিক নেতার প্রতি তেমন উচ্চ বাচ্ছ করেনা বা ঘাটাঘাটি করতে চায়না। অথচ এক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে ঐ ইউরোপীয় ইস্যু এবং ইমিগ্রেশন ইস্যু প্রশ্নে ব্রিটেনের নির্বাচন কেন্দ্রিক সময়কেই বেছে নিয়েছে ইন্টারপুলের এলার্টকে সামনে নিয়ে আসতে, অথচ ইউরোপ বরাবরের মতোই বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিএনপির সাথে লিয়াজো করছিলো প্রকাশ্যে। রাজনীতির মারপ্যাচে এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক।
আবার বিপরীত পক্ষে আওয়ামীলীগের সরকার চায়, তারেক রহমান এবং একমাত্র জীবিত ছেলের জন্য বেগম জিয়া যাতে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে অদূর ভবিষ্যতে জামাত ও কট্রর ইসলামিক দলগুলোকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করে বেকায়দায় না ফেলেন, মাথা ব্যাথার কারণ না হন, সেজন্যে নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে মাঠে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনে বিএনপিকে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও বাধ্য বিরোধীদলে পরিণত করতে ইন্টারপোলের রেড এলার্ট এবং এক্সট্রাডাইট ইস্যু সামনে নিয়ে এসেছে। উদ্দেশ্য বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানকে নিয়ন্ত্রণ। সরকার হয়তো এই কৌশলে সফল হয়ে যাবে, যেহেতু বিএনপি মাঠ ছাড়া, দাড়ানোর মতো অবস্থানে নেই। তারেক রহমানের ভিতরেও এক ধরনের অস্থিরতা সরকার সৃস্টি করতে চায়- যাতে সরকার এক্সট্রাডাইট মূলা ঝুলিয়ে রেখে তারেক রহমানকে বুঝিয়ে দিতে চায়- সমঝোতার রাজনীতি না করলে আওয়ামীলীগ এক্সট্রাডাইট এপ্লিকেশন করতে বাধ্য হবে। যদিও এই এক্সট্রাডাইট যেভাবে বলা হচ্ছে, সেভাবে ততো সহজ না। এর রয়েছে নানা পর্যায় এবং ধাপ। এতোসব জেনে শুনেও রাজনৈতিক সূক্ষ্ম এক কৌশল হিসেবে সরকার এ পথ বেছে নিয়েছে। এদিকে এমন ঢিলে ঢাকার রাজনীতি, মিডিয়া এবং আওয়ামীলীগের নিজেদের বলয় সরকার যে চাঙ্গা ও ঝড় তুলতে পারবে- তাতে সন্দেহ নাই। সরকার নিজের দলের নেতা কর্মীদের ঝিমিয়ে অবস্থা দূর করতে তারেক রহমান এক্সট্রাডাইট ইস্যু এবং মিডিয়ায় একতরফা ঝিমিয়ে ভাবকে খানিকটা রাজনীতির নামের গন্ধ দিয়ে তেজীভাব তোলার জন্য যে এমন রেড এলার্ট- সেটাও আরো একটা অপকৌশল- যা ইতোমধ্যেই মিডিয়া এবং আওয়ামীলীগ ঘরানার নেতা কর্মী বুদ্ধিজীবীদের খুড়াক হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে বিএনপির ঘরে আরো ভীতির সঞ্চার বেশ নাটকীয়ভাবে সরকার তুলে ধরতে পারছে। পাশাপাশি ইসলামিক কট্রর এবং মধ্যপন্থী দলসমূহের কাছে এই ম্যাসেজ পৌছে দেয়া যে সরকার তারেক রহমানকে ছাড় না দিলে, আরো অনেকের কপালে শনির দশা লাগতে বেশী সময় লাগবেনা। গত তিন দিনের রাজনৈতিক সিনারিও ঘরে এবং বাইরে এমন আভাষই দিচ্ছে। আগামী আরো কয়েকদিনে হয়তো তারেক রহমান ইস্যুতে সেই ধূয়ার আকাশে আরো কুয়াশা কিংবা নীলাভ আকার দেখা দিতে পারে- তা দেখার জন্য আমাদেরকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
16th April 2015, london.