Home » Featured » ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফের এক কাতারে

ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফের এক কাতারে

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ।  ভুরাজনীতির কেন্দ্রে ইতোমধ্যেই নানান পরিবর্তন সাধিত হয়ে গেছে। ইউক্রেন রাশিয়া ইস্যু সেই পরিবর্তনের মাত্রায় নতুন পারদ ঢেলে দিয়েছে। ইউক্রেন রাশিয়া ইস্যুতে বিশ্ব রাজনীতির শক্তিধর মোড়লদের মধ্যে মতানৈক্য থাকলে ছোট ছোট উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য, সমরাস্ত্র ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে এক ও অভীন্ন কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে। একই ইস্যুতে ইউরোপ ও বড় মাপের দেশগুলোর জন্য যেমন, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সেই কৌশল,নীতি ভিন্ন-যদিও তা নিয়ে রাজনৈতিক পন্ডিতদের মধ্যে রয়েছে মতানৈক্য ও সমালোচনায় মুখর।

সম্প্রতি বাংলাদেশের র‍্যাব ও মানবাধিকার এবং নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা ধীরে ধীরে খোলস উম্মোচন করে চলেছে। র‍্যাব ও মানবাধিকার ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান যেমন পরিষ্কার করেছে, ঠিক একইভাবে আগামী নির্বাচন প্রশ্নে সকল দলের অংশ গ্রহণের এক কৌশলী বক্তব্যও খোলাসাভাবে দিয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ২০০৮ সালের ন্যায় থাকলে(র‍্যাব নিষেধাজ্ঞার সময় পর্যন্ত), কেননা, নিষেধাজ্ঞার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই নয়াদিল্লির সাথে আলোচনা  না করে করেনি। নিষেধাজ্ঞার পূর্বে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের বার্তা নয়াদিল্লির টেবিল পর্যন্তই আটকে যায়,সেই বার্তা ঢাকায় আসেনি।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নো-অবজেকশন নোটে উপমাহাদেশের এই দেশটির রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে ইতস্তত করেনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সাথে প্রায় সহমত অবস্থানে যুক্তরাজ্যও নিজেদের বক্তব্য দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছে। এদিকে ভারত আগ বাড়িয়ে কিছু না বললেও নির্বাচন প্রশ্নে বিদ্যমান আইনে ও প্রতিষ্ঠানের আওতায় আগামী নির্বাচন সকল দল নিয়ে করার কথা মোটাদাগে না হলেও বলেছে।

এমনি অবস্থায় দেশের ভিতরের বিরোধীদলগুলো একমত না হলেও ছোট ছোট ও বামদলগুলো জাতীয় সরকারের অধীনে আগামীর নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মধ্যে দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি ধারা জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আর অপর ধারাটি তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচনের কথা বলছে।

এই যখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অবস্থা বা আন্তর্জাতিক মুরুব্বীদের সিনারীও সরকারের অনেকটা বিব্রতকর অবস্থানে, ঠিক তখনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর অনেকটা আগ বাড়িয়েই দীর্ঘ এক বিরতি তথা ঠান্ডা-গরম-শীতল এক সম্পর্কের আবহের মধ্যেই ঢাকা সফরে আসলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের এক্ষেত্রে সফলতাটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়-যা তাদেরকেও অনেকটা বিব্রতকর নাজুক অবস্থা থেকে শ্বাস নেয়ার অবস্থানে নিয়ে আসে। জয় শংকরের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে মার্কিন-ভারত রাজনীতির খেলার কুশলী ছকটা অনেকটাই প্রকাশ্যে চলে আসে, যদিও ঢাকা সফরের সময় জয়শংকর ঝানু কূটনীতিকের ন্যায় বেশ মুন্সিয়ানা এবং অনেকটা রাজনৈতিক খেলার ছক সকলের নাগালের বাইরে সযত্নে আগলে রাখার কৌশলী ও দক্ষতায় পারদর্শীতা দেখিয়েছেন দারুনভাবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ও উন্নয়নের এক সিংহভাগ অংশীদার চীন। শেখ হাসিনা ও মোমেনের পূর্বমুখী নীতির ফলে চীনকে নিয়ে যেমন আলোচনা তুঙ্গে, তেমনি ভুরাজনীতির খেলার ছকে ভারত-মার্কিনীরা চীনের মাত্রাতিরিক্ত অংশগ্রহণ অস্বস্তির কারণ। বাংলাদেশ এতোদিন স্বীকার করুক আর না করুক, র‍্যাব ও মানবাধিকার ইস্যু আর পাকিস্তানের ইমরান খানের আচমকা ক্ষমতাচ্যুতিতে ঢাকার গণভবন আর সেগুনবাগিচার কূটনীতিকপাড়ায় মার্কিনীদের খেলার চাল বোধগম্যে সময় বেশী নেয়নি, যার ফলে তড়িৎ ভারসাম্যের উন্নয়নের কূটনীতিকে কিছুটা আপাতঃ পিছনে রেখে পূর্বের (২০০৮) ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতীম ও একে অন্যের সহযোগী নীতিতে সেগুনবাগিচার অবস্থান ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সচিব শ্রী শ্রীংলার দপ্তরে তড়িৎ গতিতে পৌছে গেলে, ভারত সঙ্গে সঙ্গে সব অভিমান গোস্বা ভুলে গিয়ে লুফে নেয় ( যদিও সেই প্রেক্ষিত তৈরিতে আওয়ামীলীগকে অনেক কাটখড় পোড়াতে হয়েছে, পররাষ্ট্র সচিব ছাড়াও তথ্যমন্ত্রী, দলীয় সাধারণ সম্পাদক সহ একগুচ্ছ দলীয় টিমকে ভারতে পাঠাতে হয়েছিলো)।

এটা অকাট্য সত্য, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নির্বাচন ও আন্তর্জাতিক পলিসি ইস্যুতে প্রতিবেশী শক্তিশালী দেশের যেমন বিরাট এক ভুমিকা থাকে, তেমনি মার্কিনী ও পশ্চিমাদের আগ্রহ ও ইন্টারেস্ট থাকে সমান মাত্রায়।

সেগুনবাগিচার কর্তারা ভালো করেই জানেন মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের সাথে চলমান এই ইস্যুতে সুরাহা বা আগুনে বা ঘি  পানি ঢালতে নয়াদিল্লির সেই ঢাকা-নয়াদিল্লি সহযোগিতার সম্পর্ক পুণরুজ্জীবিত করার বিকল্প নেই।যদিও সেই বোধগম্যে কিছুটা নয়, বেশ দেরিই হয়ে গেছে ঢাকার পক্ষে।তারপরেও মন্দের ভালো, দেরিতে হলেও ঢাকা-নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন এক কাতারে আসতে সম্মত হয়েছে, যা আগামীর জটিল কূটনীতির পথচলাকে সহজ করবে(যদিও র‍্যাব ইস্যু সমাধানে ঢাকার জন্য কিছুটা সময় লাগবে-সম্পর্কের ক্রমাবনতির খেসারততো দিতেই হয়।সেটা সব ক্ষেত্রে, সব জায়গায়, সব দেশেই হয়ে থাকে, ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্ঠিক যেভাবেই হউক)

জয়শংকরের ঢাকা সফরের শুরুতেই ডঃ আব্দুল মোমেন র‍্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইস্যুতে ভারতের সহযোগিতার কথা খোলাসাভাবেই জানিয়েছেন। বুঝতে অসুবিধা হয়না, ইতোপূর্বেকার নানান বক্তব্য(পাবলকলি বলা হলেও), মূলতঃ এতোসব আদ্যোপান্তের মূল ছক মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রেই তিনদেশের মধ্যে বুঝাপরা(প্রচলিত বুঝাপড়া) হয়ে গেছে। কারণ ঐ একই সময়ে ভারত বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিল। বাংলাদেশকে সহযোগিতার বিষয়ে জয়শংকর কিংবা ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে কিছু না বললেও আপনাদের আব্দুল মোমেন বলবেন-ডিপ্লোম্যাটিক জবাবই সেক্ষেত্রে সিনারিও প্লট তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিল বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। শুধু র‍্যাব নয়, বাংলাদেশের নানান গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন একযোগে এক কাতারে থেকে কাজ করবে। সেই সিনারিও, সেই বুঝাপরা পরিষ্কার হওয়ার পরেই তড়িৎ তথা অনেকটা ঝড়োগতিতে জয়শংকরের দুদিনের ঢাকা সফর এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ বৈঠক ও নরেন্দ্র মোদীর ভারত আমন্ত্রণের চিঠি হস্তান্তর-সেই বুঝাপরারই(প্রচলিত বুঝাপড়া) ইঙ্গিত নয় বরং ক্লিয়ারেন্স দেয়। এই বুঝাপরায়(বুঝাপড়া) চীনের সাথে সম্পর্কের ইস্যুও অনেকটা ভারত-মার্কিন কূটনৈতিক চালের ছকেই আবর্তিত হবে, ছন্দ, গতি, তাল, লয় ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তীত মাত্রায় এগিয়ে যাবে-সেরকমই বোধগম্য।

চলবে…

৪ মে ২০২২, লন্ডন।

Please follow and like us:
Pin Share

Follow by Email
YouTube
Pinterest
LinkedIn
Share
Instagram
error: Content is protected !!