চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রা এবং এর উপস্থাপক জিল্লুর রহমান- দুই ই বেশ একে অন্যের সমার্থক। তৃতীয় মাত্রা যেমন জনপ্রিয় এক অনবদ্য অনুষ্ঠান, একই সাথে এর উপস্থাপক জিল্লুর রহমানও জনপ্রিয়।মূলত তৃতীয় মাত্রার আলোচনার প্রেক্ষিতে এর জনপ্রিয়তার মাত্রা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। দুএকটি বা দু-চারজন আলোচক ও আলোচনা বাদ দিলে এখন পর্যন্ত এই তৃতীয় মাত্রা বেশ জনপ্রিয় এক টক শো সন্দেহ নেই।এখন এই তৃতীয় মাত্রায় নতুন এক সংযোজন, মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে আলোচনা ও এর আলোচকদের বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা ও বিপরীতে দর্শকদের মতামত সরাসরি প্রচারের সুন্দর এক ব্যবস্থা।নিঃসন্দেহ এমন সুন্দর ব্যবস্থা করার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরো টিম।
সেদিন ১৪ আগস্ট ( ইউরোপের টাইম অনুযায়ী ) তৃতীয় মাত্রায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন জাতীয় পার্টির কাজী জাফর আহমেদ এবং জাসদের আ স ম আবদুর রব। দুজনের প্রাণবন্ত আলোচনা শুনছিলাম, মাঝে মধ্যে উপস্থাপক জিল্লুরও বেশ প্রশ্নবোধক বক্তব্য উনাদের কাছে তুলে ধরে জানার চেষ্টা করছিলেন। ভালো লাগছিলো। অন্যান্য টিভির টক শোর মতো তৃতীয় মাত্রায় আলোচনার একটা সুন্দর পরিবেশ ও আলোচনার গতিধারা চালিয়ে যাওয়ার ধরন আধুনিক যুগের আলোচনার সাথে বেশ মানানসই ছিলো, যা ছিলো উপভোগ্য। যদিও আলোচকদের অনেক বক্তব্যের সাথে অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ও বিতর্ক জড়িত। তথাপি সুন্দর আলোচনা করার জন্য উভয়কেই ধন্যবাদ।
তত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে উভয় আলোচক বেশ চমকপ্রদ বক্তব্যই রেখেছেন। সেজন্য সাধুবাদ।যেমন রব বলেছেন, ১৬/১৭ কোটি জনগণের একটি লোকও যে সরকার বিলুপ্তির জন্য একবারের জন্যও কোন দাবী করলোনা, সেই ব্যবস্থাকে এই সরকার নিজে থেকে বাতিল করে দিয়ে আজকের এই সংকট সৃষ্টি করেছেন।কাজী জাফর আহমেদও আ স ম রবের সাথে একমত হয়ে বলেছেন, আওয়ামীলীগের সব চাইতে বড় যে ভুল সেটা হলো তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা।
তবে এই দুই রাজনৈতিক নেতা যে বিষয়টি বারে বার আলোকপাত করেছেনে বা জনগণের দৃষ্টি নিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন, তাহলো মূলত বর্তমানের যে কাটা-ছেড়া পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিদ্যমান যে সংবিধান আছে, এই সংবিধান দিয়ে কিছুতেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যাবেনা, যদিনা আরেকটি ষষ্ট-দশ সংশোধনী এনে এই সংবিধানের সকল অসামঞ্জস্যতাকে সংশোধন করা না হয়। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে এসে ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির এই নেতার মুখ থেকে সংবিধানের এই জটিলতা নিয়ে টক শোতে বক্তব্য বিরাট তাৎপর্য বহন করে, যদিও অনেকেই আগে থেকেই বিদ্যমান এই পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে নানা মত ব্যক্ত করে আসছিলেন। যেমন রব ও জাফর বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সংবিধানকে এমন অবস্থায় আনা হয়েছে, যেখানে সংশোধনীর এক তৃতীয়াংশে বলা হয়েছে, অপরিবর্তনীয় এবং এক তৃতীয়াংশ সদস্যের উদ্যোগে কিংবা গণভোটের মাধ্যমেও পরিবর্তন করা যাবেনা। যদি করা হয় তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এসব যে অগণতান্ত্রিক এবং বিদ্যমান গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও শাসনের পরিপন্থী, এমনকি বিশ্বের কোথায়ও এমন আজব রীতি সংবিধানে নেই বলে উভয়েই জোরালোভাবে বলার সাথে সাথে আরো বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর জটিলতা নিরসনে ষষ্টদশ সংশোধনী এনেই তবেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এর বিকল্প নেই বলে মত দিয়েছেন। আ স ম রব অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, এই সংবিধানের বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশে নির্বাচন সম্ভব নয়।
আজকে ঢাকা টাইমস এবং তারও আগে দেশের অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন আলোচক এই পঞ্চদশ সংশোধনীর অসামঞ্জস্যতা নিয়ে মোটামুটি আলোকপাত করেছেন, কেউ কেউ একটু কড়াভাবে ইতিপূর্বে যখন এই সংশোধনীর সমালোচনা করেছিলেন, তখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার দোহাই কিংবা জুজুর ভয় দেখিয়ে সেই আলোকপাতকে স্তব্ধ কিংবা বিএনপি-জামায়াতের সহযোগীর তকমা লাগানোর চেষ্টার ফলে সেদিন সেই আলোচনা-সমালোচনা সেখানেই ইতি টানা হয়েছিলো। কিন্তু নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, সংবিধানের এই জটিলতা নিয়ে নতুন নতুন আলোচনা আবারো সরগরম হয়ে উঠছে।
বিদ্যমান সংশোধিত সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে (ক) উপ-দফায় উল্লেখ রয়েছে ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি শর্ত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লেখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্য রূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’ সংবিধানের এই বিধানের কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সংসদ বহাল রেখেই জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। ফলে সরকারের পুরো মেয়াদ সংসদ অধিবেশন চালাতে হলে সংবিধান সংশোধন করে নিতে হবে।
আর সরকার যদি সংবিধানের এই অসঙ্গতি দূর করার লক্ষ্যে এককভাবে এগুতে থাকে তাহলে সংঘাত অনিবার্য, ডঃ আকবর আলী সহ ট্রান্সপারেন্সীর ডঃ ইফতেখারুজ্জামান, বিএনপির শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা টাইমসের সাথে আলোচনায় তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন, যা ১৬ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে।
আবার সম্প্রতি গণ-প্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ সংশোধন করে সংসদ বাতিলের পর থেকে নতুন সংসদ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে অর্পণের সুপারিশ করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।’ সংবিধান হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। দেশের অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন সংবিধানের বিধানই প্রাধান্য পাবে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যদি নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তা সংবিধান পরিপন্থী হবে না। কিন্তু এখানেও সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দিবে, যা আলোচনা ছাড়া শান্তি পূর্ণ সমাধানের বিকল্প নেই বলে উপরোক্ত তিনজন সহ প্রায় সকলেরই একই অভিমত। অথচ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ আজকে ( ১৬ তারিখে প্রকাশিত ) বিরোধীদলের প্রতি কটাক্ষ করে এক ধরনের তাচ্ছিল্যের সাথে আলোচনা না করার কথাই বলেছেন। গতকাল মোহাম্মদ নাসিম যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অনেকাংশেই বিশৃঙ্খলাকে উস্কে দিবে বলে কারো কারো মত ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে।
কেউ কেউ এই সব অ-সমঝোতা ও ক্রমবর্ধমান অসিহিঞ্চুতার প্রেক্ষিতে অসাংবিধানিক সরকারের ক্ষমতারোহনের পথ পরিষ্কার বা উৎসাহিত করার বিষয়ে আগাম সতর্ক করে দিচ্ছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকেই এই ধরনের বক্তব্য প্রকাশ করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে যেভাবে কোরআনের মতো অপরিবর্তনীয় করে রাখা হয়েছে, তা কেন যে করা হয়েছে, যতই যুক্তি দেয়া হউক না কেন, নিছক গণতান্ত্রিক সৎ উদ্দেশ্য যে কাজ করেনি, তা এখন পরিষ্কার। আর একটি দেশের সংবিধান কখনো কোরআনের মতো হতে পারেনা, চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় করার হীন উদ্দেশ্য কিছুতেই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ও গণতন্ত্রের উন্নত মডেলের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারেনা, সেটা সকলেই মানেন এবং বুঝেন। তার পরেও এমন আজগুবি রাষ্ট্রদ্রোহী শাস্তি তকমা লাগিয়ে যেন তেন উপায়ে সুচতুরতার সাথে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার মাঝে কোন সুস্থ রাজনীতির চর্চা হতেই পারেনা। প্রশ্ন থেকে যায়, খায়রুল হক যেখানে রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনের সাংবিধানিক জটিলতার ইস্যুটিকে সংসদের উপর ন্যস্ত করে দিলেন, আওয়ামীলীগ কেন সেই গণতান্ত্রিক পথে না গিয়ে সংবিধান সংশোধনীর মতো জটিল বিষয়কে এক লাফে একেবারে বাতিল করে দিয়ে সেই সব সংশোধনী কিছুতেই সংশোধনী করা যাবেনা বলে অনুচ্ছেদ সমূহ সংযোজন করে দিলো, যার ফলে আজকের উদ্ভূত জটিলতা সৃষ্টি করে নিজেরা যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে, তা থেকে উত্তরণের কোন সমঝোতার পথে যেতে বাধা কোথায় ? রাজনীতিতে জনপ্রিয়তার পারদ উঠা-নামা করে, একভাবে যায়না। আওয়ামীলীগ কখনোই ক্ষমতাশ্রয়ী দলও ছিলোনা- এটাও সত্য, আওয়ামীলীগের বেলায় আরো সত্য। দীর্ঘ সংগ্রাম আর লড়াইয়ের এই দল এখন ক্ষমতা আর অন্ধ আনুগত্য, লুটের ভাগ,পদ্মা আর শেয়ার বাজার লুট-পাটের কাছে বড় অসহায়ভাবে আত্মাহুতি দিয়েছে, যার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট থেকে গণতান্ত্রিক পথে বের হয়ে আসতে ভয়ে মুহ্যমান।লুট-পাটের বিষাক্ত অজগরের ফনি-দশার নীচ থেকে তাই বের হয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আওয়ামীলীগের স্বেচ্ছাচার আর দাম্ভিকতার ফলে কোন অসাংবিধানিক সরকার যখন ক্ষমতায় আসবে, তখন আওয়ামীলীগ প্রণীত ঐ পঞ্চদশ সংশোধনীর সংবিধানকে পায়ের তলায় লুটিয়েই আসবে, যা আমরা কেউই তা চাইনা, যেমন করে বলেছেন রব ও জাফর এবং আরো অনেকেই। আওয়ামীলীগ কি একটু ভেবে দেখবে ?
১৬ আগস্ট ২০১৩।