গত ২২ শে মে ২০১৩ থেকে গোটা লন্ডন সহ সারা বিশ্বের মিডিয়া ও সামাজিক নেটওয়ার্ক সহ সর্বত্র যে হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঝড় তুলেছে, সারা বিশ্বের মানবতাকামি জনগণকে করেছে ব্যথিত, স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ ও উদ্বিগ্ন, বিশ্বজুড়ে সকল বড় বড় মিডিয়া ও অনলাইনে এ নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা এবং বিশেষকরে অভিযুক্ত, ঘৃণ্য অপরাধী একটি বিশেষ শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের নাম প্রকাশ্যে টেলিভিশন ফুটেজে যেভাবে নাম, রেফারেন্স উল্লেখ করে বিরাট প্রশ্ন ও গোটা বিশ্বের মানব সমাজের কাছে ঐ বিশেষ সম্প্রদায়ের তথা ইসলাম ও মুসলমানদের অপরাধের কাঠগড়ায় ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে তুলেছে, তা এই সম্প্রদায়ের তাবৎ স্কলারদের করেছে বিক্ষুব্ধ ও ব্যথিত এবং অবশ্যই করে তুলেছে উদ্বিগ্ন ।
লি রিগবী হত্যাকান্ডঃ
ইতিমধ্যেই বিশ্ব-মিডিয়ার বদৌলতে সকলেই অবগত হয়ে আছেন যে, দক্ষিণ ইংল্যান্ডের উলউইচ নামক স্থানে গত ২২ তারিখ রাতে সেনা ব্যারাকের সন্নিকটে লি রিগবী নামের এই সাহসী, শান্ত, ও পরিবার-বান্ধব ব্রিটিশ এই সৈনিক কে অত্যন্ত নির্দয় ও নির্মমভাবে নাইজেরিয়ান বংশোদ্ভূত মাইকেল আডেবালেজো ও তার সঙ্গী হত্যা করে। এই দুই নর পশু শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা দুজন প্রকাশ্যে বুক উঁচিয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন-এর উদ্ধৃতি(অপ-ব্যাখ্যা)দিয়ে তাদের ঐ হত্যাকাণ্ডের সপক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করে।ঘটনা এখানেই দুই আডেবালেজো ক্ষান্ত দেয়নি, তারা বরং সেই স্থান ত্যাগ করেনি।দুই তরুণী সাহসী মহিলা যারা প্রথম তাদের দুজনকে সনাক্ত ও ক্ষান্ত করার চেষ্টা করছিলো, তখন গলার স্বর উঁচু করে এই দুই পাষণ্ড ও পাপিষ্ঠ নিজেদের মুসলমান দাবী করে লন্ডনের রাস্তায় ঐ রাতে আগুন লাগানোর হমকী দিতেছিলো। তাদের একজন রক্তাক্ত হাতে চাপাতি এবং ছোরা ধরে রেখে নিজের দুষ্কর্মের পক্ষে সাফাই দিয়েছে। সাফাই দিতে গিয়ে সে ব্রিটিশ সরকারের বিদেশনীতির সমালোচনা করেছে এবং সেখানে কুরআনের রেফারেন্স দিয়েছে। স্কাই ও বিবিসির বদৌলতে সারা বিশ্বের জনগণ তা দেখেছেন। তখনি ইংলিশ ডিফেন্স লিগ বা বিএনপি’র মতো চরম দক্ষিণপন্থী দল এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করে । বিএনপি নেতা নিক গ্রিফিন সাথে সাথে টুইটারে মন্তব্য করেন, ‘গণহারে ইমিগ্রেশনের কারণেই এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।’ অপরদিকে ইংলিশ ডিফেন্স লিগের শ খানেক লোক ঘটনার পর পর ঐস্থানের আশে পাশে জড়ো হয়ে মুসলিম বিরোধী শ্লোগান দেয়া শুরু করে। তারা পুলিশের উদ্দেশ্যে বোতলও নিক্ষেপ করে। ইডিএল নেতা টমি রবিনসনের উক্তি উদ্ধৃত করেছে গার্ডিয়ান, টমি বলেছেন ‘ওরা আমাদের সৈনিকদের মস্তক কেটে ফেলছে। এর নামই ইসলাম, যা আমরা আজ দেখছি। তারা আমাদের এক সৈন্যের মাথা কেটে লন্ডনের রাজপথে ফেলে রেখেছে।’ সেখানে টমি আরো বলে, ‘স্কুলগুলোতে আমাদের পরবর্তী বংশধরদের শিক্ষা দেয়া হয়, ইসলাম শান্তির ধর্ম। আসলে তা নয়, এটা কখনো ছিল না। আজ আমরা যা দেখছি, এটাই ইসলাম। যথেষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রতিকার হতে হবে। সরকারকে শুনতে হবে, পুলিশকে শুনতে হবে, ব্রিটিশ জনগণ কতটুকু ক্ষুব্ধ তা তাদের বুঝতে হবে।’
হত্যাকাণ্ডের পর:
এদিকে ব্রিটিশ সেনাকে হত্যার ঘটনায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে। দুটি মসজিদ ও নিউক্যাসলে দুজন মুসলিম হামলার শিকার হয়েছেন। নাম ধরে তাদের ডাকা হচ্ছে। এছাড়াও নানা রকম নির্যাতন করা হচ্ছে। গতকাল এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। ফেইথ ম্যাটার্স নামের এই চ্যারিটি বলেছে, বুধবারের ওই হত্যাকাণ্ডের পর মুসলিমদের কমপক্ষে ১৬২টি কল পেয়েছে তারা। বুধবার থেকে প্রতিদিন তারা এমন ফোন পাচ্ছে। বলা হয়েছে, সামাজিক ওয়েবসাইটগুলোতে আপত্তিকর মন্তব্য করার ঘটনায় অনেক মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। লি রিগবিকে হত্যার পর ঘাতক মাইকেল এডেবালেজো এক পথিক ক্যামেরায় ধারণ করেন। এ সময় আডেবালেজো বলতে থাকে, ব্রিটিশ সেনারা প্রতিদিন মুসলমানদের হত্যা করছে তার প্রতিশোধ নিতে সে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এরপরই তাকে ও দ্বিতীয় আরেক সন্দেহভাজন মাইকেল আদেবোলাজো (২২)কে গ্রেপ্তার করা হয় ঘটনাস্থল থেকে। তারা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের দু’জনকেই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা ভালভাবে চিনতো। ফেইথ ম্যাটার্স-এর পরিচালক ফাইয়াজ মুঘল বলেছেন, ওই ঘটনার পর থেকে মসজিদে হামলা বেড়েছে। মুসলিম নারীদের মাথার স্কার্ফ কেড়ে নেয়া হয়েছে। নাম ধরে ডাকা হয়। তিনি বিবিসি রেডিও ফাইভ’কে বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা দ্রুত বিস্তার করায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সারা দেশ থেকে এমন অভিযোগ আসছে। কখনো কখনো খুব আগ্রাসী ভঙ্গিতে ওই আক্রমণ চালানো হচ্ছে। অনলাইনে বহু সংখ্যক মানুষ প্রচার চালাচ্ছে ব্রিটিশ সেনা হত্যাকারীর সঙ্গে মুসলমানদের যোগসূত্র আছে। এমন প্রচারণা চালানোর জন্য পুলিশ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে লিংকনের ২২ বছর বয়সী এক যুবক, লন্ডনের ২৮ বছরের এক যুবক, সাউথসি’র ২৩ বছরের এক যুবতী ও ওকিংয়ের ১৯ বছর বয়সী এক যুবক। জাতিগত বিদ্বেষ অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধে গেটসহেড থেকে দু’জন এবং স্টকটন থেকে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে নর্থামব্রিয়া পুলিশ।
এই হলো ব্রিটিশ সৈনিক লি রিগবী হত্যাকাণ্ডের পর সার্বিক চিত্র।
ডাউনিং ষ্ট্রীটের কঠোর ভুমিকাঃ
তবে এক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার এবং তার প্রশাসন তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে সমগ্র ঘটনাটিকে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্রিটিশ সমাজের ক্ষোভ, নিন্দা, জিঘাংসাকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সামাল দিয়েছেন, সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যারাই ব্রিটেনে বসবাস করেন, তারা সকলেই এতে একমত পোষণ করবেন তাতে কোন সন্দেহ নাই।কেননা, ঘটনার পর পরই ব্রিটিশ সরকার বর্ণবাদী ইডিএলের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের পরেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এ ধরণের বর্বর কাজ ইসলাম সমর্থন করে না। মুসলিম কমিউনিটি এ দেশের জন্যে অনেক কাজ করছেন। যারা এ কাজ করেছে তারা ইসলাম ও মুসলিম কমিউনিটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’ এরপর পরই উপ-প্রধানমন্ত্রী নিক ক্লেগও ডাউনিং ষ্ট্রীটের সাথে সহমত পোষণ করে বলেছেন, মুসলমানদের কোরআন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ম্যাসেজ দেয়, এধরনের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেনি। মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন তাতক্ষণিকভাবে বিবিসি টেলিভিশনে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ইসলাম কখনো সমর্থন করেনা বলে অভিমত ব্যক্ত করে। সংস্থাটির পক্ষে জাভেদ আজমী কোরানের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, এই ধরনের মানব হত্যা গোটা মানবতাকে হত্যার শামিল,যা ইসলাম এবং কোরআন কখনো সমর্থন করেনা।
হত্যাকাণ্ডের পর পরই পুলিশ ও ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেয়। সমগ্র ব্রিটেনের সব কটা শহরের মুসলিম মসজিদ, মাদ্রাসা, বড় বড় শপিং মল, রাস্তা-ঘাটে, স্কুল, কমিউনিটি সেন্টারের সামনে পুলিশী টহল জোরদার করে। পরদিন শুক্রবার হওয়াতে এই ব্যবস্থা অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে। সর্বত্র পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতির ফলে মসজিদ ও রাস্তা-ঘাটে,যানবাহনে তেমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।যদিও ইডিএল ঘটনা থেকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সকল চেষ্টাই করেছে।
আমাদের বক্তব্য:
আমাদের মতে, এ হত্যাকাণ্ড মুসলমান এবং ইমিগ্র্যান্টদের সামনে চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে। পৈশাচিক কাজকে শুধু নিন্দা করে এ চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হওয়া যাবে না। আমাদের এ স্বীকৃতি দিতে হবে, মুসলিম কমিউনিটিতে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসের বীজ রয়েছে। উলউইচ হত্যাকাণ্ডের কথিত ঘাতক চিৎকার দিয়ে বিশ্ববাসীকে তা জানিয়ে দিয়েছে। নিরপরাধ ও নিরস্ত্র ব্রিটিশ সৈনিককে হত্যা করে সে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের অপমানিত করেছে। ব্রিটিশ সরকার বা এদেশের আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা অবশ্যই সকল শক্তি দিয়ে চরমপন্থিদের মোকাবেলার চেষ্টা করবে। ইমিগ্র্যান্ট এবং মুসলমানদেরও এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামের দোহাই দিয়ে কেউ চরমপন্থা বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করলে দেশের সুশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারি না। নানা কথা মালার মারপ্যাচ বাদ দিয়ে এক কথায় চরমপন্থাকে ‘না’ বলতে হবে।
এশিয়া বা আফ্রিকার কোন দেশে এ রকম ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হতো। বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে কোন খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী যদি কোন সৈন্যকে এ ভাবে হত্যা করতো তা হলে সে সব দেশের মানুষ এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কি করতো তা কল্পনা করতেও আমরা আতঙ্কিত হই। সে তুলনায় ব্রিটেনে কিছুই হয়নি এবং এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এখানে ব্যাপক কোন হাঙ্গামা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলেও আমরা মনে করি না। কিন্তু মুসলমান হিসেবে বা ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আমাদের দায়িত্ব এবং নিজেদের রেকর্ড সঠিক ও উজ্জ্বল করার প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই।
চরমপন্থিদের চিহ্নিত করার কাজে আমাদের কথিত ঘাতকের দেয়া কুরআনের রেফারেন্সকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে দেখতে হবে।এ থেকে বোঝা যায় ধর্মীয় লেবাস ধারী কোন ‘মূর্খ-পণ্ডিত’ ঘাতককে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। যারা সরলপ্রাণ মানুষদের এ ভাবে বিভ্রান্ত করছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
আশার কথা, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ মেয়র লুতফুর রহমান, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও লিবডেমের এমপি প্রার্থী আজমল মাশরুর, ইষ্ট লন্ডন মস্ক ও লন্ডন মুসলিম সেন্টার, ফেইথ ফোরাম, কলামিষ্ট ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ফরিদ আহমদ রেজা সহ সকল শান্তিপ্রিয় মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ তীব্র ভাষায় এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন।কমিউনিটির হারমনি রক্ষার্থে সকলকে নিজ নিজ ভূমিকা পালনের আহবান জানিয়েছেন।তারা সকলেই দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে এই ধরনের ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেছেন ইসলাম কখনো এই ধরনের হত্যাকাণ্ড এলাও করেনা।এই ধরনের বিভ্রান্ত ও বর্বর ম্যাসেজ কখনো ইসলাম দেয়না। কতিপয় অর্বাচীন, মূর্খ, ধর্মের নাম নিয়ে কিছু লোককে বিভ্রান্ত করছে, এদের কাছ থেকে সকলকে সজাগ ও দূরে থাকার পরামর্শ দেন।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহের অনেক মানুষ নিজ দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিলেতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বসবাস করছেন। আইনের শাসন, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, ন্যায়-বিচার ইত্যাদির বিচারে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ব্রিটেনের অবস্থান শীর্ষ। যারা ইসলামী রাষ্ট্র বা শরিয়া আইনের কথা বলে বিলাতের রাস্তায় শ্লোগান দেন তাদের বোঝা উচিত, শরিয়া আইনে যে সাম্য ও ন্যায় বিচারের কথা বলা হয়েছে তা তথাকথিত মুসলিম দেশগুলোর চেয়ে ব্রিটেনে আমরা অনেক বেশি উপভোগ করছি। বর্তমান ঘটনা থেকেই একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। উলউইচ হত্যাকাণ্ডের আসামীদের আটক করার আগে ব্রিটিশ পুলিশ গুলি করে তাদের আহত করেছে। কারণ, ঘাতকদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য ছিল। এ সময় গুলি করা ছাড়া পুলিশের সামনে অন্য কোন উপায় ছিল কি না তা অনুসন্ধান করে দেখার নির্দেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পুলিশ কমিশনকে দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পুলিশের গুলিতে এবং পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়ে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। তা নিয়ে সরকার বা পুলিশ মোটেই মাথা ঘামাচ্ছে না। বিভিন্ন মানুষকে রিমান্ডে নিয়ে বাংলাদেশের পুলিশ দিনের পর নির্যাতন করে পঙ্গু করছে বা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীরা পর্যন্ত এ ব্যাপারে টু শব্দ করছে না। বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে সব দেশেই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। ঘৃণা ও সন্ত্রাসের প্রচার করে মুসলমানদের জন্যে নিরাপদ এবং শান্তিতে বসবাসের এ দেশকে বিনষ্ট করবেন না।
যারা চরমপন্থা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে এ দেশকে উত্তপ্ত করে তুলতে চায় তারা অবশ্যই মানবতার দুশমন। এ দেশের চরম দক্ষিণ পন্থী গোষ্ঠী এমনিতেই মুসলমান এবং ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে নানা রকম উস্কানিমূলক কথাবার্তা প্রচার করে ব্রিটেনবাসীকে উত্যক্ত করছে। কিন্তু বহুজাতিক সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ উদার গণতান্ত্রিক ব্রিটিশ সমাজ কখনো তাদের প্ররোচনায় কর্ণপাত করেনি। বিলেতের সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ বহুজাতিক গণতান্ত্রিক চেতনার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম, সম্প্রীতির ধর্ম, সহনশীলতার ধর্ম। এখানে কোন গোঁড়ামি, অহংকার, অন্ধকূপমুন্ডুকতা, হিপোক্রেসীর স্থান নেই। ইসলাম উদার গণতন্ত্র ও সাম্যের কথা বলে, প্রতিনিয়ত সংলাপ ও ইন্টারেকশনের কথা বলে।
তায়েফের ঘটনায় জিবরাঈলের জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা:)ঃ
তায়েফের মাটিতে বিধর্মীরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত করেছিলো, আরশে মহল্লা থেকে জিবরাঈল তখন তায়েফের মাটিতে রাসূলুল্লাহর কাছে এসে বলেছিলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ (সা:) আপনি যদি নির্দেশ করেন তবে তায়েফের ঐ দুই পাহাড়কে একত্রিত করে বা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গোটা তায়েফ বাসীকে শায়েস্তা করে দেই। জিবরাঈলের এমন কথার জবাবে মহানবী বলেছিলেন, জিবরাঈল আমি মোহাম্মদ (সা:)তো এসেছি মানবতার মুক্তির জন্যে, রহমতুল লিল আলামীন হিসেবে। আজকে যদি মাটির সাথে এদেরকে মিশিয়ে দাও, তাহলে কাল বা পরে ইসলামের নাম নেয়ার জন্যে তায়েফের মাটিতে একজন লোকও থাকবেনা।
মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সর্বপ্রথম বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি, সহাবস্থানের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তার সার্বিক গ্যারান্টি প্রদান করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন।
ইসলামই সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক ভাবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করে। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে খলিফা সকলের সম্মতির ভিত্তিতে নির্বাচিত হতেন, দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের খেলাফতের সময় সর্বপ্রথম মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সুতরাং ইসলাম এবং কোরআনের বাণী যাতে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়, এবং যাতে ব্রিটেনের মতো বহুজাতিক সমাজে কোন বক-ধার্মিক ব্যক্তি তরুণ প্রজন্ম ও ইসলামে নব-দীক্ষিতদের বিপথগামী এবং ইসলামের মূলমন্ত্রের অপ-ব্যাখ্যা না করে বিভ্রান্ত করতে না পারে সেজন্য কমিউনিটির এবং কমিউনিটিতে অবস্থিত বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসায় যে সব ইমাম(প্রিষ্ট) আছেন, তাদের রয়েছে বিশেষভুমিকা। আমাদের তরুণ ব্রিটিশ মুসলমানদের এবং নব-দীক্ষিতদের কাছে ইসলামের ও কোরানের সঠিক ব্যাখ্যা যাতে পৌঁছে, ইমাম সাহেবদের সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।কেননা, আমাদের ইমিগ্র্যান্টদের বুঝতে হবে, এটা সৌদি আরব, আমিরাত নয়, পাকিস্তান,নাইজেরিয়া যেমন নয়, তেমনি এটা ইরান ইরাক নয়। এটা ব্রিটেন, বহুজাতিক সমাজের বসবাস। এখানে যেকোন মুসলমান নিজেদের দেশের চাইতে অতি সহজে নিজেদের ধর্ম-কর্ম অত্যন্ত বিনয় ও পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে পূর্ণাঙ্গ রীতি-রেওয়াজের সাথে পালন করতে পারেন। সেজন্য স্থানীয় সরকার এবং ব্রিটিশ সরকারের সকল সরকারি সংস্থা ও ব্রিটিশ জনগণ পুরোপুরিভাবে যেমন সহযোগিতা করে থাকেন, একইভাবে নানান সুযোগ সুবিধাও প্রদান করে থাকেন। আর এতোসব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে, এতো ফ্রীডম ও মানবাধিকারের সকল সুযোগ ভোগ করে খোদ ব্রিটিশ সরকারের ও জনগণের কর্তন বা নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও নাশকতা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। হত্যা, বর্বরতা, নাশকতা যারা করে, উৎসাহ যোগায়-এরা সকলেই মানবতার শত্রু, মুসলমানের শত্রু, ইসলামের শত্রু, মহানবীর দুশমন। এদেরকে প্রশ্রয় দেয়া আইন ও মানবতার সাথে দুশমনি করা। সুতরাং এর বিরুদ্ধে সকলকে সোচ্চার হতে হবে।
আমরা নিহত লি রিগবীর পরিবার-পরিজন, স্ত্রী, ভাই সহ ব্রিটিশ সৈনিক ও ব্রিটিশ জনগণের সাথে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি, একইসাথে ব্রিটিশ জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মোকাবেলায় একাত্ম হয়ে কাজ করতে সকল ব্রিটেনবাসীর প্রতি আহবান জানাচ্ছি। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরাও নিরলস ভাবে কাজ করার অঙ্গীকারাবদ্ধ।
Salim932@googlemail.com
25th May 2013.UK.