লন্ডন সফরে ডঃ মোহাম্মাদ ইউনূস ও ডঃ কামাল হোসেন-বাঙালির লাল সবুজের পতাকা নবরূপে উড়ালেন

লন্ডন সফরে ডঃ মোহাম্মাদ ইউনূস ও ডঃ কামাল হোসেন-বাঙালির লাল সবুজের পতাকা নবরূপে উড়ালেন

লন্ডন সফর করে গেলেন ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস ও ডঃ কামাল হোসেন
যেন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা পত পত করে আরেকবার উড়ালেন লন্ডনে
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক দুই ব্যক্তিত্ব ব্রিটেন সফর করে গেলেন। একজন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাক্তন এমডি, অর্থনীতিবিদ, নোবেল লরিয়েট ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস, অপরজন হলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা ডঃ কামাল হোসেন। দুজনেই স্ব-স্ব-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে পরিচিত।দেশের ভিতরে যেমন হউক না কেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই দুই ব্যক্তিত্বের রয়েছে ঈর্ষনীয় গ্রহণযোগ্যতা।

ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস তার লন্ডন সফরের সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জাতিসংঘের দক্ষিণ এশিয়া ও নারী বিষয়ক সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের নেতৃবৃন্দ। গত ২১শে মে ওয়েস্টমিনিস্টারে সম্মেলন কক্ষে তাদের সঙ্গে ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস মতবিনিময় করেন।

মতবিনিময় কালে ডঃ ইউনূস বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে কীভাবে আরো উন্নত করা যায়, বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের নানা সম্ভাবনাময় দিক, নারী অধিকার রক্ষার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন। সাভার ট্রাজেডির কারণে বিদেশের মার্কেটে যাতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেদিকে ও তিনি সকলের মনোনিবেশ করেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিশ্বমান নিয়েও তিনি বেশ গর্বকরে মত ব্যক্ত করেন।

 

এ সময় অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন- সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির বাংলাদেশ বিষয়ক সহ সভাপতি লেবার দলীয় এমপি রুশনারা আলী, লর্ড সভার সদস্য- ব্যারোনেস পলা মঞ্জিলা উদ্দিন, জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির সভাপতি পওলিন লেইথ্যাম, সেক্রেটারি ব্যারোনেস হোসেইন।

এর আগে ১৯ শে মে লন্ডন থেকে অল্প দূরত্বে ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের আমন্ত্রণে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি যোগ দেন।সেখানে ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র বিমোচন করে দারিদ্রসীমা জিরো অবস্থানে নিয়ে আসতে চাই। এবং দারিদ্র বিমোচন করেই দারিদ্রকেই পাঠিয়ে দিতে চাই মিউজিয়াম কিংবা জাদুঘরে।’

ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের কাউন্সিলর আব্দুল জব্বারের পরিচালনায় এতে কাউন্সিলরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন- ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলের মেয়র ওলোওয়েন চাটার্টন ও ডেপুটি মেয়র কাউন্সিলর শোয়েব আখতার। অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সোলফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর মিঃ মার্টিন হল।

আলোচনায় ডঃ ইউনূস বলেন, ‘প্রচলিত ব্যাংকগুলো শহর খোঁজে তাদের ব্যবসার জন্যে। তারা সম্পদশালী আর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কাছে যায় আর আমাদের গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামে গিয়ে সবচেয়ে অবহেলিত গরীব মহিলাদের আমরা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েছে। নিজস্ব উদ্যোগেই একজন মহিলা নিজেরে পায়ে কিভাবে দাঁড়াতে পারেন তারই এক বাস্তব উদাহরণ গ্রামীণ ব্যাংক। ডঃ ইউনূস তার নয়া ভিশন সামাজিক ব্যবসার ধারণাও সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন, তাতে সকলেই অভিভূত হন, অনেকেই খুব আগ্রহ নিয়ে তার বক্তব্য শুনেন। এখানে তিনি দর্শকদের ও অতিথিদের নানান প্রশ্নের উত্তরও দেন। যেমন তিনি বলেন, চ্যারিটি নয়, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে স্বনির্ভর হওয়া এবং চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টি করার অনেক উদাহরণ তিনি তুলে ধরেন। তিনি আরো বলেন, চ্যারিটির জন্যে বছরের পর বছর মানুষের করুণার ওপর নির্ভর করতে হয়, অথচ সামাজিক ব্যবসার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে কাজের, যা দারিদ্র বিমোচন করে।

সামাজিকভাবে পারষ্পরিক সহযোগিতায় বিশেষ অবদান রাখে- তার নতুন এই সামাজিক ব্যবসা। এ প্রসঙ্গে তিনি তার চক্ষু হাসপাতালের কথা তুলে ধরেন। কোন চাঁদা নয়, সামাজিক ব্যবসার মধ্য দিয়েই তাদের এই হাসপাতাল এখন প্রতিবছরে ১০ হাজার ক্যাটারেট অপারেশনের মানুষের চোখে আলো দিয়ে থাকে। দরিদ্র মানুষের জন্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা কিংবা সম্পদশালীদের জন্য মূল্যসহ(ফিসসহ) চিকিৎসা দিয়ে ব্যবসায়িক ভারসাম্য রক্ষা করেই একের পর এক সেবামুলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করছেন তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান।

এর সপ্তাহ খানেক আগে প্রখ্যাত আইনজীবী ডঃ কামাল হোসেন লন্ডন সফর করেন। লন্ডন সফরের আগে চ্যানেল আই তাদের নিউজ স্ক্রলে ডঃ কামালের লন্ডন সফরের প্রাক্কালে তার রচিত বই বাংলাদেশে-এর লন্ডনে প্রকাশনী উপলক্ষে লাইভ আলোচনা অনুষ্ঠানের ঘোষণা প্রচার করে।

 

চ্যানেল আইতে সরাসরি প্রচারিত ঐ অনুষ্ঠানে ডঃ কামাল হোসেন অত্যন্ত খোলামেলা ভাবে বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনীতি, অর্থনীতি, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেন। তাতে ছিলোনা কন খেদোক্তি, কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা নালিশের মতো সুর। বরং চ্যানেল আইতে লাইভ আলোচনার মাধ্যমে এবং অগণিত প্রবাসীদের প্রশ্নের উত্তরে লন্ডনে একটি প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশ বিরোধী যে ন্যক্কারজনক অপ-প্রচার চালিয়ে প্রবাসীদের বিভ্রান্ত করে আসছিলো, ডাউনিং ষ্ট্রীট সহ ফরেন অফিসে নিয়মিত নালিশ করে আসছিলো, তার যুতসই, অত্যন্ত যুক্তিনির্ভর ভাবে প্রকৃত বাস্তব দৃশ্যাবলী জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন।এমনকি লন্ডনের বিভিন্ন আলোচনা ও মতবিনিময় সভাতে হেফাজতের শাপলা অভিযান নিয়ে যে অতিরঞ্জিত হত্যাকাণ্ডের কথা বলা হচ্ছিলো, তার উত্তরে ডঃ কামাল লন্ডনে তার সফরের সময় দ্ব্যার্থহীনভাবে মাস-ম্যাসাকারের বিরোধিতা করে শানিত যুক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করেন।তিনি স্পষ্টতই বলেন মাস-ম্যাসাকার হয়নি, যারা একথা বলছেন তারা মিথ্যা তথ্য দিতেছেন।

অথচ বাংলাদেশের খ্যাতিমান এই দুই দিকপালকে দেশের ভিতরে সরকারিভাবে কতোনা তাচ্ছিল্য করা হয়।

সারা বিশ্বের সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ব্রিটেনের লন্ডন, এর রয়েছে নানান কারণে সুখ্যাতি। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বেশীরভাগ জনগণের বসবাস এই লন্ডন শহরে। যেকারণে বিলেতের এই লন্ডন শহরকে বলা হয়ে থাকে দ্বিতীয় বাংলা। কেননা, প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতিমুহূর্তের দেশের ভিতরকার খবর যেমন এই লন্ডনের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে, একইভাবে বিলেতের এই লন্ডনের আনাচে-কানাচে কখন কোথায় কি হচ্ছে, সে সংবাদও বাংলাদেশের সর্বত্র মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সব কটি দলের শাখা-প্রশাখা ব্যাপকভাবে এই লন্ডনে রয়েছে, 
দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ঢাকা শহরের মতোই এই লন্ডন শহরে প্রতিনিয়ত পালিত হয়ে থাকে। দেশের মতোই এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর হাঙ্গামা, দলাদলি, হাড্ডা-হাড্ডি প্রতিযোগিতা চলে আসছে। ঢাকার মতোই এখানে লঘি-বৈঠা না হলেও আকারে-ইঙ্গিতে সেরকম মারামারিও হয়ে থাকে, প্রেস কনফারেন্স, সভা-সমাবেশতো আছেই সারাক্ষণ। ঢাকার রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী, সচিব, ডাইরেক্টর, কর্পোরেট প্রধান, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সকলেই ঢাকার পরেই এখন এই লন্ডনে নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভিত্তি ও শক্তিশালী ঘাটি-এ যেন আমেরিকার মতো মার্কিন সামরিক আধিপত্যের ঘাটি স্থাপনের ও শো-ডাউনের উপস্থিতি প্রায়ই এখানে লক্ষ্য করা যায়। আজকাল বিলেতের ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার বদৌলতে প্রতিমুহূর্তের লন্ডনের এই সব সভা-সমাবেশ আর শো-ডাউনের খবরাখবর সকল প্রবাসীদের নখ দর্পণে। উপরন্তু মিডিয়ার বদৌলতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, মন্ত্রী মহোদয়দের সাথে সরাসরি প্রশ্ন ও উত্তরের এক সুযোগ এখন প্রবাসীরা সহজেই পেয়ে থাকেন।

বিগত কয়েক বছর ধরে ব্রিটেনবাসী লক্ষ্য করে আসছেন যে, কি সরকারি, কি বিরোধী, কি ইসলামপন্থী যে কোন দলের বা মতাদর্শের নেতা-নেত্রী লন্ডনে আসেন, যখনি কোন সুযোগ হয়, ডাউনিং ষ্ট্রীট কিংবা ফরেন অফিস বা হাউস অব কমন্স বা লর্ড সভার কোন সদস্যা বা সদস্যার সাথে সাক্ষাত বা আলোচনা কিংবা মতবিনিময়ের সুযোগে বাংলাদেশের ভিতরকার রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আর্জি, নালিশ, কখনো কখনো নিজেদের সমস্যায় তাদের হস্তক্ষেপ বা চাপ প্রয়োগের জন্য সুপারিশ,দাবি,দেন-দরবার করে থাকতে দেখা যায়, যা মিডিয়ায় সচিত্র সেই সব বক্তব্য, খবর প্রকাশিত হয়ে আসছে। ইদানীং বাংলাদেশের নেতা-নেত্রী আর মন্ত্রীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে লন্ডনের সেই সব নেতা-নেত্রীর দলীয় অনুসারীরা প্রতিনিয়ত এমপি ও লর্ড সভার সদস্যদের সাথে দেখা করে নালিশ জানানোটা যেন আরো এক নতুন ফ্যাশন হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেখানে প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা, দেখ-ভাল আর দেশের জনগণের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যার উন্নয়নে ভূমিকা বা আজকের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য আমাদের নেতা-নেত্রী আর মন্ত্রী মহোদয়দের ডাউনিং ষ্ট্রীটে বা কমন্স সভায় দেন-দরবার বা সুপারিশ করার কথাছিলো, সেখানে আমরা দেখছি বিপরীত চিত্র। আর এই বৈপরীত্যের মধ্যে একটু ব্যতিক্রম এক সফর করে গেলেন এই দুই প্রথিতযশা বিখ্যাত ব্যক্তিত্বগণ। ডঃ ইউনূস, ডঃ কামাল দুজনের কাউকেই তাদের সফরে কোন নালিশ, অভিযোগ কিংবা দেশের ভিতরকার রাজনৈতিক সমস্যায় আমাদের বিদেশী বন্ধুদের হস্তক্ষেপ বা চাপ-প্রয়োগের কথা বলতে শুনিনি। ব্যতিক্রমধর্মী পজিটিভ এই সফরে সত্যি অনেক প্রবাসীদের সাথে আমরা সকলেই খুশী এবং আনন্দিত হয়েছি। এই দুই ব্যক্তিত্ব তাদের লন্ডন সফরের মধ্যদিয়ে বরং দেশের ভাব-মূর্তি কি করে উজ্জ্বল করে তোলা যায়, ইনোভেটিভ নবতর চিন্তাধারার কথা প্রকাশ করে বাঙালির আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারণা লন্ডনের সরকারি ও একইসাথে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাথে শেয়ার করে গেছেন।সেজন্য তাদের দুজনকেই প্রবাসীদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। অনেক প্রবাসীকে আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সকলে না হলেও বড় বড় নেতৃত্বের মাঝে যদি এই রকম দেশ দরদী, দেশের ভাবমূর্তি উপরে তুলে ধরার গুণাবলী থাকতো কিংবা সচেষ্ট হতেন, তাহলে আমাদের সকলের ও দেশের জন্য অনেক কল্যাণকর হতো।

 

Salim932@googlemail.com
21st May 2013.UK

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *