জ্বলছে আরাকান, ভাসছে রোহিঙ্গা, বিশ্ববিবেক জেগে উঠো প্লিজ-

জ্বলছে আরাকান, ভাসছে রোহিঙ্গা, বিশ্ববিবেক জেগে উঠো প্লিজ-

জ্বলছে আরাকান, ভাসছে রোহিঙ্গা,বিশ্ববিবেক জেগে উঠো প্লিজ-

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ

বেশ কিছুদিন হলো মায়ানমারের আরাকান প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণের নারী, শিশু,বৃদ্ধা,যুবক,যুবতীদের উপর স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ট বুদ্ধিষ্ট জনগণ কর্তৃক অমানবিকভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের সচিত্র প্রতিবেদন আল-জাজিরা সহ নানা মিডিয়ার বদৌলতে প্রকাশিত হয়ে আসছিলো।আক্রমণ, নির্যাতন ও নদীতে, সাগরে ভাসমান মুসলমান,নারী, শিশুদের দৃশ্য এতোই ভয়াবহ ও অমানবিক যে, বিবেকবান কোন মানুষের পক্ষে চোখের জল আটকে রাখা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়।মানবতার সকল নীতিকে ভুলুন্ঠিত করে বার্মিজ বুদ্ধিষ্টরা এতো ভয়াবহ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, তা রুখার কিংবা বন্ধ করার জন্য যেন নেই কোন কর্তৃপক্ষ, নেই কোন সংস্থা।মানবতার ধব্জাধারী মার্কিন মুল্লুক, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইউএনএইচসিআর,এমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন,ওআইসি,জোটনিরপেক্ষ ও কমনওয়েলথ সহ সারা বিশ্বের সকল মুরুব্বী ও সংগঠণ আজ যেন নাকে,মুখে,চোখে কলুপ ও কালো কাপড় ঢেকে রেখেছে, এতো ভয়াবহ নিপীড়ন ও নির্যাতন চলতেছে নিরীহ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর, অথচ একটিবারের জন্য মানবতার সেই সব কান্ডারীরা একেবারে নীরব।এমনকি প্রভাবশালী বিশ্ব মিডিয়াও আজ যেন দুএকটি দায় ছাড়া গোছের সংবাদ প্রকাশ ছাড়া এই সব বীভৎস অবস্থার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত সংগ্রহে তেমন কোন সংবাদ প্রকাশ করতে দেখা যায়না।অথচ এর আগে আমরা দেখেছি ইরাক,আফগানিস্তান, লিবিয়া,মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইথিওপিয়া সর্বত্র সেই সব মিডিয়া ও মানবাধিকারের প্রবক্তারা সর্বশক্তি নিয়ে যেন ঘোষিত, অঘোষিত যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে।লজ্জা হয়, বড় কষ্ট হয়, বড় অপমানিত বোধ করি, নিরীহ রোহিঙ্গাদের প্রতি একতরফা এতো ঝুলুম, এতো নির্যাতন, এতো অত্যাচার চলতেছে, অথচ বার্মিস সরকার সহ সারা বিশ্বের মানবাধিকারের সংগঠণ ও নেতাদের যেন একটুখানি হলেও ঠনক নড়েনা।হায় এই কী আমাদের মানবতা?,এই কী আমাদের বিশ্ব বিবেক?

৮ম শতাব্দিতে আরাকান রাজা কর্তৃক মাফকৃত এরাবিক শব্দ রাহমা থেকে পরবর্তীতে চলে আসা রহম, তার পর ধীরে ধীরে চলে রোহাঙ্গ থেকে রোহিঙ্গা আসার ধারাবাহিক তথ্য উইকিপিডিয়াতে থেকে রোহিঙ্গা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা এই রকমই দেওয়া হয়েছে, যদিও ঐতিহাসিকদের মধ্যে এমনকি বার্মিস ঐতিহাসিকরা কিছুটা হলেও দ্বিমত পোষণ করেন।তারপরেও মোটামুটি ভাবে ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ একমত যে ১৯৫০ এর আগে এই রোহিঙ্গা ঐতিহাসিকভাবে দৃশ্যতা প্রতীয়মান হয়নি।তথাপি ১৮২৪ এর ব্রিটিশ সেনসাসে  রোহিঙ্গা নামক শব্দটি না থাকার কথা ডঃ মোং যদিও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ১৯৫০ এর কলোনীয়ান এরাতে আরাকানে মাইগ্রেটেড হয়ে আসা এই রোহিঙ্গা সম্পর্কে তিনি কোন দ্বিমত পোষণ করেননি, যা আরেক চায়নিজ ঐতিহাসিক

ওয়া চেন তার ষ্টাডি রিপোর্টে দেখিয়েছেন।

আরাকান প্রদেশে প্রায় সর্বসাকুল্যে ৮ লক্ষের ও কিছু অধিক এই রোহিঙ্গা মুসলিমদের বসবাস, যা ৮ম শতাব্দী থেকেই আরবদেশ থেকে মুসলমান সেটলারদের চলে এসে বসবাস আজকের পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।১৭৮৫ সালে বার্মার সংঘাতের সময় ৩৫ হাজারের কিছু রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে নিকটবর্তী চট্রগ্রামের আশ্রয় গ্রহণ করে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীজ অকুপাইডের সময়কালীন প্রায় ৪০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বার্মিজ ও জাপানীজ ফোর্সের হাত থেকে রক্ষা পেতে চট্রগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন।অর্ধশতাব্দী ধরে চলে আসা মায়ানমারের বর্তমান জান্তা সরকার এই রোহিঙ্গাদের সাথে অমানবিক আচরণ করে আসতেছে, বিগত ২০১২ সালে আরাকানের এই প্রদেশে বুদ্ধিষ্ট-রোহিঙ্গা ঐ দাঙ্গায় ৬৫০ রোহিঙ্গা নিহত, ১২০০ জন মিসিং প্রায় ৮০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বসবাসচ্যূত হয়েছিলেন বলে বার্মিস রোহিঙ্গা অর্গেনাইজেশন সূত্রে উইকিপিডিয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, যা বার্মিস সরকারের সূত্রে আরো অনেক কম বলে উল্লেখ করা আছে । শিক্ষা-দীক্ষা আর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে এরা বড় অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্টী, মায়ানমারে দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক তথা সুবিধাবঞ্চিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অবাঞ্চিত হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছেন।মূলত সরকারী অনুকূল্যহীন ও সকল প্রকারের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে এরা বঞ্চিত।এবং এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসতেছে, তার পরেও মোটামুটিভাবে চলে যাচ্ছিলো তাদের দিনকাল, কিন্তু বাধ হয়ে দাঁড়ায় সাম্প্রতিক কালের দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও ভয়াবহ নির্যাতন, যা বাধ্য করেছে সকল স্তরের রোহিঙ্গা জনগোষ্টীকে প্রাণ বাচানোর জন্য কোনভাবে একটুখানি আশ্রয়ের সন্ধানে সাগরের উত্থাল ঢেউকে পেছনে ফেলে পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় খোজার এই যে প্রাণান্ত চেষ্টা, তা দেখেও আমাদের বিশ্ববিবেক যেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।মনে হচ্ছে এ যেন আরো এক ফিলিস্তিনের মতো নয়া উদ্ভাস্ত হতে চলেছে। হায় মানবতা, হায়রে  বিশ্ববিবেক । গহীন অরন্যে যে মা তার দুধের শিশু সন্তান নিয়ে প্রাণ বাচাতে আশ্রয় নিলো, কিংবা সমুদ্রের উত্থাল তরঙ্গরাশির সাথে যুদ্ধ করে যে শিশু সন্তানকে নিয়ে যে অসহায় পরিবারটি বেচে থাকার উদগ্র বাসনা নিয়ে নিকটবর্তী দেশে আশ্রয় চাইলো,প্রিয় পাঠক ভেবে দেখুন তার কি দূষ?এই পৃথিবীতে আপনার আমার মতো তারওতো বেচে থাকার অধিকার আছে। একদিন পাকিস্তানী সৈন্যদের তাড়া খেয়ে আমরাও উদ্ভাস্ত হয়ে ভারতীয় সীমানায় ও নিকটবর্তী শহরে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেদিন ভারত সরকার তার সাহায্যের হাত আমাদের নিরন্ন নিরশ্র অসহায় জনগণের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলো।কিন্ত আজ কেন সেই একইভারত সরকার অসহায় রোহিঙ্গাদের একটূ আশ্রয়-প্রশ্রয় কিংবা সহিংসতা বন্ধে কূটনৈতিক কোন উদ্যোগ নিতেছেনা কেন? ভারত সরকারের মানবিক মূল্যবোধ কিংবা বিশ্বমানবতার প্রতি যে দায়বোধ তা কি একেবারে লোপ পেয়ে গেছে ?

আরাকান প্রদেশের সব চাইতে কাছের দেশ যেমন বাংলাদেশ, তেমনি আরো নিকটবর্তী দেশ হলো ভারতের মতো প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক দেশ।গণতন্ত্রের ধিকপাল, সম্পদে, শক্তিতে বলিয়ান, বিশ্ব সভায় প্রভাববিস্তার করার মতো ক্ষমতাবান ভারত সরকার অসহায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নিষ্টুর নীরবতা, আমাদের  বিবেককে আরো ভাবিয়ে তুলেছে। অথচ ভারতের মতো দেশের একটুখানি উদ্যোগ বার্মিজ সরকার ও জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্টানের ঠনক নাড়িয়ে দিতো।ভারতের মতো বিশাল বড় দেশে রয়েছে অসংখ্য মানবিক সংগঠণ এবং মানবতাদী অনেক লেখক, সমাজদরদী, রাজনৈতিক কর্মী । রোহিঙ্গাদের প্রতি বার্মিজ জান্তা ও বুদ্ধিষ্টদের অমানবিক আচরণের ও বর্বরতার প্রতিবাদ করার মতো যথেষ্ট আন্তর্জাতিক শক্তি ও সামর্থ্য ভারতের মতো বিশাল দেশ ও তার জনগণের রয়েছে।কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, আর আজকের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং অনেক সংবেদনশীল মনের অধিকারী বলে বিশ্বসভায় ব্যাপক সমাদৃত, তাদের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রভাবের রয়েছে জগৎখ্যাতি, রোহিঙ্গা জনগোষ্টীর প্রতি যে অন্যায় ও অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে, তাদের একটূখানি কূটনৈতিক উদ্যোগ পরিস্থিতিকে অবশ্যই অনেকটা সহনীয় করার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতো বলে অনেকেরই ধারণা।

গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে খ্যাত ব্রিটিশ সরকার যেন এক্ষেত্রে খুব একটা উল্লেখ করার মতো কোন ভূমিকাই রাখছেননা।মানবিধারের তকমার একচ্ছত্র প্রভূ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ যেন চোখ-কান একেবারে বন্ধ করে বসে আছে। খোদ জাতিসংঘের মতো বিশ্বসভাও আজ এই ব্যাপারের অন্ধ হয়ে আছে।রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়ানোর মতো যেন কেউ নেই।অথচ এই সব বিশ্ববিবেক ও প্রভূরা মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে দিনের পর দিন নানাদেশে বোমার আঘাতে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিতেও পিছুপা হয়নি।শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও শান্তির প্রবক্তা বলে খ্যাত নেলসন মান্ডেলা থেকে শুরু করে বার্মিজ নেত্রী অং সান সূচী ও বোধগম্য কারণে বড় নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছেন, যা বিশ্ব মানবতার জন্য বড়ই হতাশ করে তুলেছে।

সারা বিশ্বের এতো ডোনার এজেন্সী ও দাতা গোষ্টী রয়েছে, যারা নানা কারণে অনেক দেশের জনগণের সাহায্যে চলে আসেন, অথচ এতো বড় বড় ম্যাসাকার হতে চলেছে, ঘর-বাড়ী,ভিটে-মাটি হারিয়ে এই সব রোহিঙ্গাদের জন্য কোন দাতা গোষ্টী, ইউএনএইচসিআর এর মতো কোন সংস্থারও যেন কোন দায়বদ্ধতা নেই।হায়রে মানবতা!হায়রে বিশ্ববিবেক!আরাকান আজ জ্বলছে, জ্বলে-পুড়ে ছার খার হয়ে যাচ্ছে, রোহিঙ্গারা প্রাণের ভয়ে দিক-বিদিক হয়ে ছুটে চলছে, যারা দৌড়াতে পারছেনা, তাদেরকে কচু কাঠা করা হচ্ছে,এমন নৃশংস বর্বরতা দেখেও যেন কোন বিবেকবান বিশ্বনেতাদের ঠনক নড়েনা, আর কতো রোহিঙ্গা রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত হলে বিশ্বনেতা ও জাতিসংঘের ঠনক নড়বে ? মুসলিম নের্তৃত্ত্বের ধব্জাধারী সৌদী আরব আর আরব আমিরাতের মতো দেশের সরকার প্রধান ও ওআইসির মতো সংস্থাও আজ নীরব এবং দায় ছাড়া গোছের বিবৃতি ছাড়া আর কোন কাজ চোখে পড়ছেনা। অথচ এই সব সরকার ও বিশ্ব নেতাদের একটূ খানি উদ্যোগ পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো অনেকখানিই সচেষ্ট হতো।

আফগান, তিয়েনমার স্কোয়ার, তাহরীর স্কোয়ার,ইরাক, সানা, লিবিয়ায় যে বিশ্ববিবেক ছিলো সোচ্চার, কোথায় আজ সেই বিশ্ব ? সেখানে ছিলো তেল,টাকা আর সম্পদের লোভনীয় হাতছানী আর অস্রের বাণিজ্যের নোংরা খেলা, আর এখানে এই রোহিঙ্গাদের নেই কোন তেল, টাকা, সম্পদ, এখানে তেমন কোন অস্রবাণিজ্য করার সূদূঢ় কোন অবস্থাও পরিলক্ষিত হচ্ছেনা, তাই বলে কী মানবাধিকারের সূত্র এখানে কোন কাজে লাগানো যাবেনা ? বিশ্ববিবেক কী আজ টাকা আর তেল বাণিজ্য আর অস্র বাণিজ্যের কোপানলে বিক্রী হয়ে বসে আছে?

বিশ্ববিবেক দোহাই তোমার এমন করে চুপ করে থাকোনা, তা হলে আমাদের সুকুমার সব অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে, পেশী শক্তি আর অস্রের জনজনানীতে গোটা জনপদ প্রকম্পিত হয়ে উঠবে, আমরা তা কেউই তা চাইনা। আগামী প্রজন্মের জন্য এই বিশ্বকে আমরা বাসযোগ্য ভূমি হিসেবে রেখে যেতে চাই- এই হউক আমাদের সকলের ঐকান্তিক চাওয়া ও কামনা।

তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া ও বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গেনাইজেশন ইউকে থেকে নেওয়া-

Salim932@googlemail.com

22nd August 2012.

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *