নূর আলম জিকু ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধ্বাঞ্জলী-

নূর আলম জিকু ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধ্বাঞ্জলী-

রীতিমতো চমকে যাওয়ার মতো এক সংবাদ,বিশেষ করে প্রবাস জীবনের নিরানন্দ জীবনে চরম হতাশা আর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ এক অকল্পনীয় এক সংবাদ-প্রিয় নেতা নুর আলম জিকু ভাই আর নেই ।এই মাত্র যিনি খবর পড়ছিলেন, মনে হলো যেন, তিনি সঠিক সংবাদ বলতে ভুলে গেছেন,ইথারে ঝম-ঝম করে পাথরের মতো কঠিণ বর্ণমালা সারা ঘরময় প্রতিশব্দ হয়ে এক ভূতুরে পরিবেশ তৈরি করল ।নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিলনা,ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো,হার্ট-বিট খুব দ্রুত উঠানামা করতে লাগলো,নিঃশ্বাস নিতে বড় কষ্ট হচ্ছিল,চোখ ঝাপসা হয়ে এলো,অনেক্ষন কাদলাম-একান্তে।বারে-বার মনে পড়ছিলো জিকু ভাইয়ের মায়াবী মুখের সেই কোমল ডাকঃ কেমন আছিস সেলিম,বাবা কেমন আছেন?আমাকে দেখলেই বাবার কথা জীজ্ঞেস করতেন, পরিবারের সকলের খবর নিতেন,আশ্চর্য হতাম এই ভেবে যে এত বড় একজন বড় মাপের নেতা হয়ে আমার মতো এক অতি সামান্য একজন মানুষকে এতো আদর-স্নেহ করে কাছে ডেকে নিতেন,একই সাথে পরিবারের সকলের সংবাদ নিতে বিন্দু মাত্র ভুল করতেননা।জীকু ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে তাই আজ মনের জানালায় সকল স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগলো,মনে পড়লো প্রথমবার জিকু ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের কথা,কতো অবলীলায়,কতো সহজে আপন করে নিয়েছিলেন।প্রাথমিক পরিচয় শেষে মনযোগ দিয়ে পড়া-লেখার খুব তাগিদ দিলেন, দেশ-জাতি-সমাজ কল্যান মূলক কাজের প্রতি উজ্জীবিত করলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারনে আমাকে বেশ কিছুদিন আবাসিক সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়, এই সময় আমার বন্ধু,কুষ্টিয়ার ছাত্রলীগ নেতা,সহপাঠি মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে ।শহীদের কল্যানে ঐ সময় আমি আবাসিক সমস্যার দূর্ভোগ এর হাত থেকে রক্ষা পাই,দীর্ঘদিন আমি এবং শহীদ এক সাথে সূর্যসেন হলের ৫২৭ নম্বর কক্ষে থাকি,ঐ সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি জনাব বজলুর রহমান ভাই আমাদের সাথে থাকতেন,পরে আমার জন্য বরাদ্বকৃত ৪০৮ নম্বর কক্ষে চলে যাই ।এরশাদ সরকারের দমন-পীড়ন এর মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ডামাঢোল বেজে উঠে,মূলত শহীদ,বজলু ভাই,আ,স।ম রব ভাই আর জিকু ভাইয়ের সুবাদে ঐ সময় আমাকে ডাকসু নির্বাচনে রেজাআরিফসেলিম পরিষদে প্রতিদন্ধিতা করতে হয় । আজ মনে পড়ছে, ডাকসু ইলেকশনের মনোনয়ন দাখিলের পর বন্ধু শহীদ আমাকে জিকু ভাইয়ের বাসা ওয়াইজ ঘাটের বাসভবনে নিয়ে গেলে জিকু ভাই স্বভাবসূল্ভ ভঙ্গিতে হেসে কুশল জিজ্ঞেস করে আগে বাবা-ময়ের,পড়া-লেখার খবর নিয়ে তারপর নির্বাচনের দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন।ঐ সময় আমি খুব আর্থিক সঙ্কটে ভুগছিলাম,ভাবতে আজও আশ্চর্য হই,কখনো মুখ ফুটে বলিনি,এমনকি একই রুমের বাসিন্দা হয়েও বন্ধু শহীদকে পর্যন্ত বলিনি,অথচ দেখি,শহীদের মাধ্যমে প্রাইভেট নাম লেখা সিলগালা এনভেলাপ,এতে কিছু টাকা

২)

আর তাতে লেখা কিছু মনে করিস না,কোন সংকোচ নিবেনা,এটা রেখে দিস আপাতত,পরে না হয় ফেরত দিয়ে দিস,এখনকার সমস্যা অন্তত সমাধান কর…।গভীর অন্তরদৃষ্টি সম্পন্ন, প্রখর ব্যাত্তিত্ব, আর দায়িত্বজ্ঞ্যানসম্পন্ন এক বড় মাপের রাজনীতিবিদ ছিলেন ।

জিকু ভাই বলতেন খুব সুন্দর করে,শব্দ চয়ন ছিল গোছানো,বাক্যবিন্যাস ছিল পরিপাটি করে সাজানো,কি গোলটেবিল,কি রাজনীতির মঞ্চ,কি জনসভা,সংসদ,সেমিনার সবখানেই বলতেন অত্যন্ত গোছানো,সুন্দর-সাবলীল উপস্থাপনা,অধিকতর যুক্তি সহ, সহজ-প্রাঞ্জল ভাষায় নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের এক অসাধারন গুনের অধিকারি ছিলেন, যা আজকের যুগে বড় দূর্লোভ ।অপরের বক্তব্য মনযোগ দিয়ে শুনতেন,গভীর ভাবে উপলব্ধি করতেন,বক্তব্যের ভিতরে চলে যেতেন, তারপর শান্ত ধীরে প্রাঞ্জল ভাষায় নিজের বক্তব্য এমন ভাবে উপস্থাপন করতেন,একটু আগেও যিনি জিকু ভাইয়ের সাথে দ্বিমত করতেন,তিনিও উনার সাথে একমত হয়ে যেতেন ।আ স ম আব্দুর রবকে যখন ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে নির্বাচনের দিন গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন দেখেছি জিকু ভাই সকল ষড়যন্ত্র রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করে প্রিয় নেতা রব ভাইকে জেল থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন ।

জিকু ভাইয়ের চলে যাওয়ার সংবাদে আজ খুব করে মনে পড়ছে,দ্বিধাবিভক্ত জাসদের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে রব ভাইয়ের এসাইনম্যান্ট নিয়ে আমরা যখন মাঠে তখন জিকু ভাইয়ের অপরিসিম আন্তরিকতা আর নানান কর্মকৌশল আমাদেরকে সে দিন দারুন উদ্দীপ্ত করেছিল ।

ব্যাক্তিগত জীবনে জীকু ভাই যা বিশ্বাস করতেন, তা গভীরভাবে মানতেন,কোনরকম ভনীতা তার মাঝে ছিলনা।সত্য সব সময় অকপটে প্রকাশ করতেন।সমাজ বিভাজনের জটিল বিষয়গুলো সূক্ষ,সাবলীল আর যুক্তিগ্রাহ্য করে পুংখানুপুংখভাবে বিশ্লেষণ করে সকলের সামনে তুলে ধরতেন।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অকোতভয় বীর সেনানী নূর আলম জ়ীকু ভাই ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্বের সময় বি,এল,এফ-এর সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ডেপুটি কমান্ডার,জাসদ জাতীয় কমিটির প্রাণ,ছিলেন এক সময় জাতীয় সংসদের বিরুধীদলীয় চীফ হুইপ ।আমাদের ভাষা আন্দোলনের সময় স্কুলে থাকাকালীন সময়ে তিনি সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করেন।

আমার বিয়ের সময় শারিরীক অসুস্থতা সত্বেও রব ভাইয়ের পরিবারের সাথে ঢাকা থেকে ছুটে আসেন বিয়ের অনুষ্টানে শরিক হতে ।জ়াসদের আরো এক প্রাণ পুরুষ মরহুম মোহাম্মদ শাহজাহান আর রব ভাইয়ের প্রতি ছিল জিকু ভাইয়ের অসাধারন ভালোবাসা।

পারিবারিক জীবনে জিকু ভাই স্ত্রী,দুই ছেলে,আর এক মেয়ের গর্বিত বাবা।চোখের সমস্যা ছাড়াও নানাবিধ শারিরীক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন জিকু ভাই।প্রায়ই তাকে মাদ্রায,ব্যাংকক ট্রিটম্যান্ট এর জন্য দৌড়াতে হতো।বিদেশে থাকার কারনে খুব একটা যোগাযোগ করতে না পারার ব্যার্থতার কথা স্বীকার করে যখন আলাপ হতো, বড় ভালো লাগতো,সকলের কথা জিজ্ঞেস করতেন, সর্বশেষ এলিফ্যান্ট রোডের তার ব্যাবসায়িক অফিসে দেশের রাজনীতি,অর্থনীতি,সমাজনীতি নিয়ে

৩)

অনেক কথা হয়, আব্বার মৃর্ত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন ।বয়সের ভারে তাকে কখনো নূয়ে পড়তে দেখিনি,দেশ-মাতৃকার জন্য অনেক আক্ষেপ করেন,তখনো ভাবতেও পারিনি জিকু ভাইয়ের সাথে আর দেখা হবেনা,বিধির খেলা বুঝতে পারিনি-এটাই আমার শেষ দেখা…।

খোজ নিয়ে জানতে পারলাম, গত ১লা ফেব্রুয়ারী ২০১০ জিকু ভাইয়ের শরীরের অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর সমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।অবশেষে গত ২১ ফেব্রুয়ারীর দিন ভোর ৫টারও কিছু পরে জিকু ভাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন(ইন্নালিল্লাহি—-রাজিউন)।

আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ জিকু ভাই এর মতো একজন স্য,মেধাবী,দেশপ্রেমিক, সমাজ পরিবর্তনের এই লড়াকু সৈনিকের মৃর্তুতে জাতির এক অপূরনীয় ক্ষতি হলো,যা সহজে পূরন হবার নয়। বাংলাদেশের শ্রমজীবি-কর্মজীবি-পেশাজীবি জনতার অধিকার আধায়ের আন্দোলন,দেশ শাসন,নীতি প্রণয়ন,বাস্থবায়নে শ্রমজীবী-কর্মজীবি-পেশাজীবি জনগনের আন্দোলনে এক বিরাট শুন্যতার সৃষ্টি হলো,জাসদ যেমন হারালো তাদের এক মহান নেতাকে, পরিবার হারালো তাদের প্রিয়তম মানুষটিকে,একইভাবে আমরা হারালাম জাতির এক দিকপালকে।

মৃর্ত্যু অবশ্ব্যম্ভাবী-প্রতিটি মানুষকেই এই মৃর্তুর স্বাদ নিতে হবে, কিন্তু মানুষ বেচে থাকে তার কর্মে। জ়ীকু ভাই বেচে থাকবেন আমাদের হ্রদয়ে আজীবন,বাঙ্গালীর মনের মণিকোঠায়, এ দেশের শ্রমজীবি-কর্মজীবি-পেশাজীবি সহ সর্বস্থরের মানুষের হ্রদয়ে,আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধে,শহীদ মিনারে,আমাদের অহংকার-লাল-নীল-সবুঝ পতাকায়,জয়তু জীকু ভাই,আপনাকে লাল সালাম,আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুন ।

(লেখক বর্তমানে যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত,সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা,বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল)।

Published in Notundesh.com, daily Uttorpurbo,Pakkik Alor Michil Dhaka.

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *