একজন ইলিয়াস কাঞ্চন এবং নিরাপদ সড়ক চাই

একজন ইলিয়াস কাঞ্চন এবং নিরাপদ সড়ক চাই

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদঃ

 

ইলিয়াস কাঞ্চন বাংলাদেশের একসময়ের খ্যাতিমান নায়ক, প্রযোজক, পরিচালক। খ্যাতির শীর্ষে যখন কাঞ্চন, তখন তার সান্নিধ্য পাওয়া ছিলো অসাধ্য এক কাজ।৮০`র ইলিয়াস কাঞ্চন  বাংলা চলচ্চিত্রের একজন সুপার স্টার- তখনকার জনপ্রিয় নায়ক রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর, সোহেল রানার দাপুটে অভিনয়ের বিপরীতে একজন ইলিয়াস কাঞ্চলনকে নিজের একটা নিজস্ব বলয় করে নেয়া, নিজের আলাদা এক জগত করে নেয়া, দর্শক হ্নদয়ে দাগ কাটা এতো সহজ ছিলোনা। বসুন্ধরা সিনেমা দিয়ে যার যাত্রা- সেই ইলিয়াস কাঞ্চলনকে একে একে চরম জনপ্রিয় ছবি সহ ব্যবসাবহুল সিনেমার অপরিহার্য এক তারকা খ্যাতি এনে দিয়েছিলো- যেখান থেকে পেছনে ফিরে তাকানোর সময় ছিলোনা। দৈনিক বাংলায় কাজের সূত্র টুকটাক চিত্রালীর সাথে যোগাযোগ। তাই শাহাদত ভাইয়ের মাধ্যমে ইলিয়াস কাঞ্চন পর্যন্ত পৌছা। সেদিনের জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন জনপ্রিয়তার জোয়ারে তাই ছোট খাটো সংবাদ কর্মীকে মনে রাখার কথা নয়- এমন ধারণাই ছিলো এতোদিন।

 

ইলিয়াস কাঞ্চন যখন জনপ্রিয়তার হিমালয়ের চূড়ায়- তখনি তার জীবনে ঘটে যায় পর পর দু` দুটো দুর্ঘটনা। যে ঘটনাগুলো ইলিয়াস কাঞ্চনকে পোশাকী এই গ্ল্যামারার্স জগতের প্রতি এক ধরনের অনীহা এনে দেয়। একদিকে প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারাকে  হারিয়ে নিজে যেমন উদভ্রান্ত ও দুটো শিশু সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় ব্যাকুল, অপরদিকে কাঞ্চনের ব্যক্তিগত জীবনে আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিজের জীবন হয়ে উঠে বিপন্ন। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের  ফলে কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানার মর্মান্তিক মৃত্যু আর জনপ্রিয়তা পেছনে ফেলে দেশ ও জনগনের জন্য নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার কারণে যেটুকু সকলের কাছে ব্যাপক পরিচিত, সেই অংশটুকু অবতারনা না করে কাঞ্চনের জীবনের দুর্ঘটনার স্মৃতির আলোকেই সম্প্রতি সাক্ষাত হওয়া অভিজ্ঞতা আলোকে কিছু কথা মাত্র (এখানে)।

 

 

kanchon

 

 

তখন  এরশাদ সরকারের (সামরিক-অসামরিক) শাসন । আ স ম আবদুর রব বিরোধী দলীয় নেতা। সম্ভবত মরহুম কাজী জাফর আহমেদ প্রধানমন্ত্রী। ইলিয়াস কাঞ্চন তখনো সুপার স্টার। ভেজা চোখ, বেদের মেয়ে জ্যোতস্না- তাকে এনে দ্য়ে অসম্ভব খ্যাতি।সেদিন মধ্যরাত কিংবা মধ্যরাতের শেষের দিকে আমরা তখন সংসদ ভবনে বিরোধী দলীয় নেতার কক্ষে কর্মরত। এমন সময় খবর এলো নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছেন। সম্ভবতঃ বাচবেননা। এমন সংবাদে সবাই হত বিহ্বল । আমরা তখন বিরোধী দলীয় নেতার বাসায় রওয়ানা দেই। সেখানে গিয়ে দেখি নায়ক রাজ্জাক, সোহেল রানা, চাষী নজরুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম খোকন সহ আরো অনেকেই। সবার একটাই কথা- রব ভাই আপনিই পারেন- ইলিয়াস কাঞ্চনকে এখনি জরুরী ভিত্তিতে বিদেশে না পাঠালে বাচানো যাবেনা। নায়ক রাজ্জাকের চোখের পানি  আজো ভাসছে। মনে হচ্ছিলো কাঞ্চন যেন রাজ্জাকের আরো এক ছেলে। সম্ভবতঃ এরশাদ দেশের বাইরে ছিলেন- তাই সবার ধারণা ছিলো, অন্য কারও মাধ্যমে কাঞ্চনকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে গেলে সময়  লাগবে এবং সেজন্যে হয়তো কাঞ্চনকে বাচানোও যাবেনা। ডাক্তাররা বলেছিলেন কাঞ্চনকে বাচানো গেলেও হাত পা সব বাকা কিংবা অবস হয়ে যাবে। প্ল্যাস্টিক সার্জারি করলেও একই অবস্থা ও আশঙ্কা হেতু সবাই ছিলেন উদ্বিগ্ন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আ স ম আবদুর রবের বীরত্বের অনেক কাহিনী ও কথা ইতিহাস, লোকমুখ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় শুনেছিলাম। সেদিন গভীর রাতে দেখলাম তার বাস্তব প্রমাণ। সমস্ত আইনী জটিলতাকে তোড়াই কেয়ার করে নেতার মতো কঠিণ বজ্র কন্ঠে সব জায়গায় নির্দেশ দিচ্ছিলেন, যে করেই হউক পরবর্তী ৬ ঘন্টার মধ্যেই বিশেষ ফ্লাইটে হলেও কাঞ্চনকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর পাঠানোর সব ব্যবস্থা ও আয়োজন সরকার ও চলচ্চিত্র শিল্পী প্রযোজক পরিচালকদের সাথে মিলে করেছিলেন।

 

 

০২) ইলিয়াস কাঞ্চন সুস্থ্য হয়ে ফিরে এলেন এবং কাজও শুরু করলেন। জনপ্রিয়তাও ভাটা পড়েনি বরং আরো জনপ্রিয় হলেন।হিমালয় পর্বতের মতো জনপ্রিয়তা অতি যত্নের সাথে পেছনে ফেলে জনকল্যাণের জন্যে লেগে গেলেন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে। আমি সঙ্গী হলাম কাঞ্চনের। শুরুটা ছিলো বড় কঠিণ এবং অত্যন্ত ভয়াবহ। এতো জনপ্রিয় নায়ক হওয়া সত্যেও সতীর্থ বন্ধু, নেতা, কর্মী, সমাজ দরদী, ব্যবসায়ী কোন ক্ষেত্র থেকেই সহযোগিতার বিপরীতে বিদ্রুপ আর হাসি ঠাট্রা করেছিলেন। কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চন সিনেমার হিরোর মতো ছিলেন লক্ষ্যে অবিচল। যেকোন বাধা বিপত্তি পেরিয়ে যাওয়ার জন্যে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কাঞ্চনের ভিতরে সেদিন সে বিশ্বাস, একাগ্রতা এবং সংকল্প দেখেছিলাম, মনের অজান্তেই ক্লিয়ার ম্যাসেজ পেয়েছিলাম নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে শুধু পৌছবেনা, সমাজে পরিবর্তন সাধনে ব্যাপক ভুমিকা রাখবে।

 

 

 

 

০৩) গত সপ্তাহে দেখা হলো ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে  লন্ডনে। এসেছিলেন বেতার বাংলায়। আমাকে সাক্ষাতকারও দিয়েছেন অবলীলায়। সাক্ষাতকার শেষে বুকে জড়িয়েও ধরেছেন। বলেছেন অনেক কথাই- একেবারে মন খুলে আলাপ করেছেন। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের বর্তমান, ভবিষ্যৎ আর আশু কর্মসূচীগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। দেশ, জনগন এবং আগামী প্রজন্মের জন্যে সড়ক ও যানবাহনে  চলাচল শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ করার জন্যে তার এই আন্দোলন- আজ দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ সহ নানান সংঠণ এবং সরকার বাহাদুর ইলিয়াস কাঞ্চনের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নানান সুপারিশমালা নিয়ে কাজ করছেন। এর সুফলতা পাওয়াও শুরু হয়েছে। সড়ক ও নদীপথে সেটা পাওয়াও যাচ্ছে। রেলপথ নিয়েও নিরাপদ ভাবছে বলে জানালেন।বেতার বাংলায় সাক্ষাতের পর কাঞ্চনকে বললাম, যাবেন চ্যানেল আইতে আমার একটা প্রোগ্রাম আছে শুক্রবার রাতে হয়- এক্সক্লূসিভ অনুষ্ঠান। ব্যস্ততা এবং অন্যান্য কমিটম্যান্ট সত্যেও ইলিয়াস কাঞ্চন সময় দিলেন সহাস্যে। সাথে থাকলেন  সেলিম উদ্দীন চৌধুরী এবং ফখরুল ইসলাম।নিরাপদের এই দুই সঙ্গীও অসম্ভব সহযোগী। ধন্যবাদ সেজন্যে তাদেরও।

 

 

 

০৪) ইলিয়াস কাঞ্চনের সব চাইতে যে গুণটি আমাকে বেশী আকর্ষন করে, আর তাহলো কাঞ্চনের মতো আকাশছুয়ী অনেক জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা আমাদের দেশে আছেন এবং ছিলেনও। এরকম আকাশছুয়ী জনপ্রিয়তা থাকা অবস্থায় কেউই জনগনের কল্যাণের জন্য নিজের শ্রম-ঘাম-ঘাটের পয়সা একেবারে বিলিয়ে দিয়েছেন এমন কারও দেখা দৃশ্যমান নয়। আমি যদি ভুল করে থাকি কেউ আমাকে শুধরে দিলে কৃতার্থ হবো। কাঞ্চনের এই গুণটির সাথে আরো একটি গুণ লক্ষ্যণীয়, আর তাহলো আমাদের উপমহাদেশে এমনকি বিশ্ব পরিমন্ডলে গ্ল্যামারার্স জগতে কেউ তারকা খ্যাতিকে পূঁজি করে সামাজিক কল্যাণমূলক বা সেবামূলক কাজে যোগ দিলেও পরবর্তীতে এখন পর্যন্ত প্রায়  সকলেরই একটাই টার্গেট থাকে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া বা এমপি, মন্ত্রী হওয়া, দলবাজী করা। ইলিয়াস কাঞ্চন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমদের মধ্যে ব্যতিক্রম- নিজের জনপ্রিয়তাকে পূঁজি করে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সফলতার ও জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত অবস্থানে নিয়েও এরকম দলবাজী, ক্ষমতার স্বাদ বা মন্ত্রী এমপি হওয়ার লোভ থেকে মুক্ত( এখন পর্যন্ত)। একান্তে খোলামেলা আলোচনায় যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম- কাঞ্চন আমার মতের সাথে একমত পোষণ করে বলেছেন, এরকম কোন কিছু হওয়ার তার মোটেও ইচ্ছা নেই।

 

kanchon

 

 

ইলিয়াস কাঞ্চন একটা  সড়ক দুর্হাঘটনায় সুশ্রষা দেয়ার জন্যে হাসপাতাল এবং হাইওয়ের বিভিন্ন জায়গায় ট্রমা সেন্টার সহ যেসব সুন্দর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, জীবন রক্ষার জন্যে, পরিবারের জন্যে, দেশের জন্যে, সমাজের জন্যে, আগামী প্রজন্মের জন্যে- সেই সব প্রজেক্টের সাফল্য যেমন কামনা করি, সেই সাথে বিশ্বব্যাপী আমাদের অনেক সোনার ছেলে রয়েছেন, যারা সফলতার একেবারে শীর্ষে রয়েছেন- তারাও চাইলে কাঞ্চনের  এই সুন্দর উদ্যোগের সঙ্গী হয়ে সফল করে দিতে পারেন সহজে। কেউ কী এগিয়ে আসবেন- আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ সড়কের এই আন্দোলনের সঙ্গী হতে, পরজনমেও জীবন রক্ষাকারী ও সেবাদানকারী এই আন্দোলনের সওয়াবের ভাগীদার হওয়ার জন্যে।

 

salim932@googlemail.com

24th July 2016, London

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *