চলমান রাজনৈতিক সংঘাত এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চল সহ যে সব এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছেন, তাদের বাড়ি ঘরে পরিকল্পিতভাবে এবং বলা যায় কোথাও কোথাও পূর্ব শত্রুতার জের, একই সাথে ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল এবং জামায়াত এক হয়ে ঐ সব হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, সহ নানা সম্প্রদায়ের লোকদের উপর নির্বিচারে হামলা, অগ্নি সংযোগ, লুট পাট সহ নানা অপকর্ম ও অমানবিক কর্মকাণ্ড সাধিত হচ্ছে। এমননা যে এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। সব কটা সংগঠন ও নানা শ্রেণী পেশার মানুষজন যখন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং এই সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক তাণ্ডবের বিরুদ্ধে এক হয়ে এর প্রতিকারের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতেছে, তখনো কোথাও কোথাও রাতের অন্ধকারের এক দুটো ঘটনা ঘটেই চলছে। বিশ্ব মিডিয়া, আল জাজিরা, এবং দেশের ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার বদৌলতে এই তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলার চিত্র যখন প্রকাশিত হয়, তখন নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয়না। মানুষরূপী ঐ সব হায়েনা আর জন্তু জানোয়ারের মতো তাণ্ডব দেখে বিশ্ব বিবেক হতবাক, বিমূঢ়। কি করে নিজ দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণ, মা বোনের উপর এমন অত্যাচার নিপীড়ন ও জ্বালাও পোড়ায়ের ধ্বংসলীলা চালাতে পারলো ? এই সব কাজ যে বা যারা করেছে, এরা সকলেই দেশের শত্রু, জাতির শত্রু। এরা মানবতার দুশমন। এদের কোন দল, দেশ, জাত পাত থাকতে পারেনা।
শাহরিয়ার কবির বিবিসির সাথে সাক্ষাতকারে আজকে বলেছেন, এই সব ধ্বংসলীলা মূলত ভোটকে কেন্দ্র করে এবং যারা ভোটে গিয়েছে, তাদের বাড়ী ঘরে জামাত শিবির তাদের বারণ না শুনার কারণে এসব তারা করেছে। আবার এমনও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ তিনি পেয়েছেন, স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্রোহী আওয়ামীলীগের পরাজিত প্রার্থী জামায়াত শিবির বিএনপির সাথে মিলে এমন তাণ্ডবের উৎসবে মেতে উঠেছিলো। প্রশাসনের চরম উদাসীনতা ও গাফিলতিও সেসব রুখতে ব্যর্থতার কথা শাহরিয়ার কবির বিবিসিকে বলেছেন।
গণজাগরণ মঞ্চ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বাম প্রগতিশীল সংগঠন, সাংস্কৃতিক সামাজিক সংগঠন সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই তাণ্ডব আর হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ভাই বোনদের বাড়ি ঘরে আগুন আর তাদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে সোচ্চার। সকলেই এর সুবিচার চাচ্ছেন। আজ সকলেই আমাদের এই সংখ্যালঘু ভাই বোনদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
সমাজের সর্বস্তর থেকে দাবী উঠেছে এর বিচার ও অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের। এই ঘটনা যাতে কোনভাবেই রাজনৈতিকভাবে কালার করা না হয় বা প্রকৃত অপরাধীদের রাজনীতিকীকরণের আড়ালে চাপা দেয়া না হয়, সকলে শ্রেণীর মানুষ আজ সেব্যাপারে সোচ্চার।
সারা বছর বিভিন্ন ইস্যু, রাজনৈতিক ইস্যু, গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ব্যবসা, আর বিশ্বব্যাপী নানা বক্তৃতা আর সুনামের কথা যিনি বলে বেড়ান, নসিহত করেন, আমাদের সেই সোনার ছেলে নোবেল লরিয়েট ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস- দেশের এতোবড় ন্যক্কারজনক তাণ্ডবলীলার বিপরীতে মিডিয়ায় কোথাও একটা বিবৃতি কিংবা কোনধরনের বক্তব্য না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কারণ ইউনূস আমাদের জাতীয় গর্ব, জাতির অহংকার-আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এহেন ইউনূস দেশের এই সংখ্যালঘু ভাই বোনদের উপর ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে জাতিকে এবং সংখ্যালঘু ভাইবোনদেরকে আশার আলো দেখাতে পারতেন, এর বিরুদ্ধে সারা জাতির ঘৃণা ও ঐক্যের সূচনা করতে পারতেন। আওয়ামীলীগ বিএনপির রাজনৈতিক দ্বন্ধ এবং ক্ষমতার কাড়াকাড়ির রাজনীতি নিয়ে এক পক্ষ অবলম্বন করে জাতিকে নসিহত করতে পারেন, সেটা আমরা সারা বছর ধরেই দেখেছি। অথচ বাংলাদেশের এতোবড় তাণ্ডবের ব্যাপারে ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস নীরবতা- আমাদেরকে আহত করেছে।
ডঃ ইউনূস আমার প্রিয় মানুষদের একজন। তারমতো একজন গুণীব্যাক্তি আমাদের সংখ্যালঘু ভাইবোনদের উপর এই হামলা নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং তাদের মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার হলে সংখ্যালঘুদের সাথে আমরা সকলেই আশান্বিত হতে পারতাম। কেননা ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরে সকলেই এই ঘটনা নিয়ে রাজনীতি ও ফায়দা লুটার অপ-তৎপরতায় লিপ্ত।
সংখ্যালঘু ভাইবোনদের পাশে ইউনূসের মতো বিশ্ব খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা যদি না দাঁড়ান, তাহলে আর কারা দাঁড়াবে ? কেননা, এ জাতির সকলেইতো নানা অপকর্মে ও স্বার্থের খেলায় মত্ত। নাহলে প্রতিটি নির্বাচনের পর পরই অথবা ক্ষমতার পালাবদলের সময় এই বিশেষ শ্রেণীর লোকদের উপর জন্তু জানোয়ারের মতো এক শ্রেণীর লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর এই জাতি তখন কেবলমাত্র সোচ্চার হয়। সরকার তখন এগিয়ে আসে তাদের রক্ষায়, বিরোধীদল সহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ তখন এগিয়ে আসে। কিন্তু কেন ? কেন এই হত্যাকাণ্ড ? কেন তাদের উপর বার বার এই আক্রমণ ? এই অবস্থা থেকে কি তাদের মুক্তি নেই ? এই কি আমাদের মানবতা, এই আমাদের গণতন্ত্র ? জবাব দেবেন কি সকলেই যারা দেশ জাতি ও গণতন্ত্র আর ভোট ভোট খেলা নিয়ে খেলেন ?
একজন প্রধানমন্ত্রী, একজন মন্ত্রী, একজন সাংসদ, একজন বিরোধীদলীয় মন্ত্রী, একজন সুশীল সমাজ, একজন ইউনূস- সকলেই নিজেদের নিরাপত্তা আর মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার এবং সিদ্ধহস্ত। অথচ দেশের এই সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদানের মতো ন্যূনতম সাংবিধানিক মৌলিক গ্যারান্টিটুকু এই দেশ, এই জাতি, এই সরকার, এই বিরোধীদল কেউই দিতে পারেনা। এরপরেও এরা সকলে মিলে জাতির নিরাপত্তা, উন্নতি আর মানবাধিকার উন্নয়ন আর রক্ষার কথা বলে, মোটাদাগের দাবি নিয়ে টেলিভিশন ফাটিয়ে তুলে। লজ্জা হয় সেই সব কুশীলবদের, ধিক সেই সব বিকৃত রুচির আর মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত আর চিন্তার দরিদ্রতায় ক্লিষ্ট নেতা আর নেত্রীদের।
নোবেল নিয়ে গর্ব করে সারা দেশ জাতি ও বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তুলেন, অথচ নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের জান মালের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষায় থাকেন নীরব। কিন্তু কেন হে বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ইউনূস ?
গতকাল বলেননি, আজ বলুন অন্তত এই নিরীহ লোকদের জান মালের নিরাপত্তা আর শিশুদের রক্ষার জন্যে আওয়াজ তুলুন মাননীয় মান্যবর। সবাই রাজনীতি করছে, আপনি অন্তত: এদের পাশে এসে দাঁড়ান, এদের বাঁচান- আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে। কারণ এ লজ্জা আপনার আমার সকলের-সমগ্র জাতির।
11 January 2014.