সম্ভবত: তখন ১৯৮২ সালের শেষের দিক। এমসি কলেজ হোস্টেলে বিকেল বেলা বসে আছি। ভাবছি কি করা যায়। এমন সময় সদা হাস্যোজ্জলভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে সহাস্যে আমাদের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। পরিচয় পর্বের পর একনাগাড়ে অনেকগুলো মূল্যবান কথা অনর্গল বলে গেলেন,সিলেটী নাগরী, ফার্সি, উর্দু, আরবি, বাংলা কতো ভাষা মিশ্রণ করে সমান তালে বলে চললেন। নাজিম হিকমত সহ হাসান হাফিজুর রহমান, ফররুখ আহমেদ, মীর মোশাররফ হোসেন, জসীম উদ্দিন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কবিতা, সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে একের পর বলে চললেন।
কখনো একনাগাড়ে এমন করে এর আগে কারো কাছ থেকে এতো বড় বড় কবি লেখকদের কবিতা, উপমা, অনর্গল ভাষায় এর আগে শুনিনি। ঠিক শুনিনি বললে ভুল হবে, শুনেছি, ভালো লাগেনি। এই প্রথম একজন খুব সুন্দর উপমা ও অলংকারিক ভাবে কবিতাকে রূপক ও নানা অঙ্গের ছন্দে পাঠকের কাছে নিখুঁত বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরলেন।বেশ ভালো লাগলো। আস্তে আস্তে আলাপ চলতেই লাগলো। সিলেটী নাগরী ও ভাষা ও লোকসাহিত্য নিয়ে বিশাল তথ্য ভাণ্ডার মেলে ধরলেন আমাদের সামনে। যা রীতিমতো অবাক করার মতোই। এর আগে কেউ কখনো সিলেটী ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে এমন করে তুলে ধরেননি। এভাবেই অনেকক্ষণ চলে আমাদের প্রথম কথোপকথন। এতোক্ষন যার সাথে পরিচয়ের প্রাথমিক পর্বের কথা বলছিলাম তিনি ই হলেন আজকের আমাদের প্রয়াত রম্য লেখক, গবেষক, সাংবাদিক যে নামেই ডাকি না কেন, কম বলাই হবে-আমাদের সকলের প্রিয় সৈয়দ মোস্তফা কামাল।মোস্তফা ভাইয়ের সেদিনকার এই আলাপচারিতা মনে খুব দাগ কেঠেছিলো। যাবার আগে বিরতি দিয়ে আবারও নাম জিজ্ঞেস করলেন। বললাম সেলিম মোস্তফা ভাই। বললেন, না পুরো নাম, বাবার নাম, বাড়ী সবই জানতে চাইলেন। পুরো নাম বলার পরে বিনয়ের সাথে বললেন, জানেন সৈয়দ নামের অর্থ, তাৎপর্য । সত্যি বলতে কি মোস্তফা ভাইয়ের কাছ থেকে সেদিন এই প্রথম এই সৈয়দ নামের গুঁড় তাৎপর্য, প্রকৃত ইতিহাস, প্রিয় নবীজীর মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের ধারাবাহিকতা আর কেয়ামতের দিনে সৈয়দ বংশের উজ্জ্বলতা ও উৎকৃষ্টতা- প্রথম এতো বিস্তারিতভাবে অবগত হয়ে নিজেকে খুব ধন্য মনে হলো। আর সেদিন থেকেই জানার প্রতি একরকম আগ্রহ- মোস্তফা কামালের সান্নিধ্যে না এলে হয়তো অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতো। যখন জানলেন, আমি ডঃ মোমেনের ছোট ভাই, ডাঃ শাহ আনোয়ার আর শাহ কামালের ভাগনা, তখন আমাকে খুব যত্নের সাথে বললেন, তাহলেতো তোমার লেখালেখি ও সাংবাদিকতার প্রতি ঝোঁক বেশী থাকার কথা। বলা বাহুল্য মোস্তফা কামাল নিজেই বললেন তিনি ডঃ মোমেনের খুব কাছের বন্ধু এবং ঐ সময় ডঃ মোমেনকে নিয়ে তিনি একটি বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন। মোস্তফা কামাল যে সময়ে ডঃ মোমেনকে নিয়ে বই লিখছিলেন, তখন আমার জানা মতে আমার এই মিষ্টি ভাইটি সৌদি আরবে বাদশা ফাহদের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
সেদিন কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে যায়।মোস্তফা ভাইয়ের সাথে টিলাগড় বইয়ের দোকান(তখন মেইন রোডে বেশ কিছু বইয়ের দোকান ছিলো)পর্যন্ত এসে বিদায় দিয়ে চলে যাই। বিদায়ের আগে আগামীকাল ইসলামিক ফাউন্ডেশন সিলেট(তখন শিবগঞ্জ-মীরাবাজারের মাঝামাঝি কার্যালয় ছিলো, সাথে ছিলো ইরান দূতাবাস কর্তৃক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ডান পাশের দোতলায় ছিলো )এ মুসলিম রেনেসাঁ ও আমাদের বাংলা সাহিত্য নিয়ে এক আড্ডায় আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন জরুর আসতে হবে। যেমন কথা তেমন কাজ। পরদিন মোস্তফা ভাইয়ের অনুপ্রেরণাতেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঐ আলোচনায় গিয়েছিলাম। যেখান থেকেই সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লেখালেখির সাথে জড়িয়ে পড়ার আমার অনুপ্রেরণার উৎস এই মোস্তফা কামাল ভাই।ইরান দূতাবাসের নানা সাংস্কৃতিক তথ্য বিনিময় প্রোগ্রামে মোস্তফা ভাইয়ের সাথে বহু বার গিয়েছি।
মোস্তফা কামাল ভাই ই পরে আমাকে সিলেটের মুসলিম সাহিত্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার নিয়মিত বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডা ও কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত করেছিলেন। মোস্তফা ভাই নিজে উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে আমাকে যুগ ভেরীতে লেখালেখি ও সিলেটের ডাক এ লেখালেখিতে জড়িয়েছিলেন। তখন কিইবা লিখতাম, তেমন ভালো হতোনা। কিন্তু মোস্তফা ভাইয়ের সেকি উৎসাহ আর উদ্দীপনা। বার বার জোর দিয়ে বলতেন, সেলিম একাজে লেগে পড়ো, এখানেই তোমার ক্ষেত্র। সেদিন বুঝিনি-কিন্তু পরিণত বয়সে এসে বুঝতেছি, মোস্তফা ভাইয়ের সেই তীক্ষ্ণ আর ক্ষুরদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আহ্বান –আজকে আমার জীবনে কতোখানি প্রভাব ফেলে আছে, সেটা জীবনের পরতে পরতে অক্ষরে অক্ষরে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ধোপা দীঘির পারে আমার বড় খালার বাসায় মোস্তফা কামাল ভাইয়ের সাথে আমার শেষ সাক্ষাত। ঐদিন আমি সিলেটের তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি শফিউল আলম নাদেলের সাথে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম আমার মিষ্টি ভাইটিকে রিসিভ করার জন্য। রিসিভ করে সরাসরি জেলা বার ডিসির অফিস হয়ে আমরা ভর দুপুরে নাদেলের পুরনো মডেলের(আজকে সেই নাদেল অনেক মস্ত বড় ব্যবসায়ী) ব্লাক কালারের কার দিয়ে ধোপা দীঘির পারে চলে আসি। সেখানে এসে দেখি আমাদের আগেই এসে হাজির হয়ে আছেন মোস্তফা কামাল ভাই। মিষ্টি ভাই ফ্রেস হওয়ে আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতাদের সাথে সাক্ষাত করতে লাগলেন। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। (কারণ ঐ সময় প্রথমবারের মত ছোট ভাই আজকের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ইউএনডিপির কনসালটেন্সি ছেড়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সরাসরি অভিষেক এবং হুমায়ূন রশিদের মৃত্যুতে সিলেটে হেভি ওয়েট প্রার্থীর যে সংকটে আওয়ামীলীগ ভুগছিলো, ছোট ভাইয়ের অভিষেকের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ সেই সংকট কাটিয়ে উঠে। বলাই বাহুল্য এর দুদিন পরেই ছিলো সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে আবুল মাল আব্দুল মুহিতের আওয়ামীলীগের গণ-সম্বর্ধনা।সেখান থেকেই ছোট ভাইয়ের নির্বাচনী যাত্রা-যা আজকের সফল অর্থমন্ত্রী)। আমি আর মোস্তফা ভাই জমপেশ আড্ডা জমিয়ে ফেলি। সেদিন ভর দুপুর হয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত মোস্তফা ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ আলোচনা হয় দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে। ৯৬ সালেই উনাকে তখন বেশ কাহিল লেগেছিলো। জানালেন রোগে শোকে এখন উনি অনেক কাতর। গত বছর হজ্জ্ব করে এসেছেন জানালেন। আমাকে সাথে থাকা হজ্জ্ব নিয়ে উনার লেখা বই এবং মিষ্টি ভাইয়াকে নিয়ে উনার লেখা বই ছাড়াও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা ধর্মী বই তিনটি উপহার হিসেবে দিলেন। আমি তখন লন্ডন প্রবাসী হয়ে আছি-প্রথম তিনি জানলেন। মোস্তফা ভাইয়ের ধারনা, আমি নাঈমুল ইসলাম খান কিংবা আবুল হাসনাত(প্রয়াত মশালের পাবলিকেশনার,অথবা জনতার সাথে সানাউল্লাহ নূরীর তত্বাবধানে) ভাইয়ের সাথে কাজ করি। বললেন মাজে মধ্যে লেখা দেখেই উনার এমন ধারনা। তবে একটু মুন্সিয়ানা আসার কথাও ঘটা করে জানান দিয়ে আমাকে টিপ্পনী কাটলেন। জিজ্ঞেস করলেন আইএফআইসির চাকুরী কবে কখন ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিলাম। বললেন ভালোই করেছ, দেশের যে অবস্থা, আমাদের তারুণ্য এখন প্রতিনিয়ত দেশ থেকে পালাতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাচে ।
এর পর মোস্তফা ভাইয়ের সাথে আর দেখা নেই। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার সিলেটে গিয়েছিলাম।কবি দিলওয়ারের অসুস্থতায় দেখতেও গিয়েছিলাম। কেন জানি আর মোস্তফা ভাইয়ের কথা একেবারেই ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে টেলিভিশন নিউজে আমার সেই প্রিয় মোস্তফা কামাল ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে স্তম্ভিত ও বিমূঢ় হয়ে যাই। স্মৃতির পাতা ক্রমাগত পেছনে নিয়ে চলে। চোখের সামনে ভেসে উঠে মোস্তফা কামাল ভাইয়ের কোমল আর অমায়িক হাসি খুশী চেহারা।সিলেট বাসী শুধু নয়, মোস্তফা কামাল ছিলেন বাংলাদেশের শেকড় সন্ধানী মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। সদা হাসোজ্জ্বল আর অমায়িক ব্যবহার মোস্তফা কামাল ভাইকে করে তুলেছিলো সকলের কাছে অনন্য। অসাধারণ জ্ঞান আর জ্ঞান লব্ধ অভিজ্ঞান সকলের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার দুর্লভ এক গুনের অধিকারী ছিলেন মোস্তফা কামাল ভাই। ছোট বড় সকলকে তিনি ভীষণ স্নেহ ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। কাজের প্রতি একাগ্রতা ও সত্যানুসন্ধানের এক দুর্লভ চরিত্রের অপূর্ব এক সমন্বয় ছিলেন মোস্তফা ভাই।
বুকের মধ্যে বড় কষ্ট আর দুঃখের মেঘ মালা জমতে থাকে ক্রমাগত। কেন জানি মনে হয় বড় দেরী করে ফেলেছি, একবারও আর শেষ না দেখার এই বেদনা সারাটি জীবন বুকে নিয়ে বেড়াতে হবে।
প্রিয় মোস্তফা কামাল ভাই, আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুন। আপনি বেচে থাকবেন আপনার কর্মে, আপনার সাধনায়, শেকড়ের সন্ধানে সদা নিয়ত একদল অভিযাত্রীর পথের আলোর দিশা হয়ে। আপনাকে আমাদের অজস্র শ্রদ্ধাঞ্জলি- বাঙালির মনের একেবারে অতলান্ত প্রদেশ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা। বিদায় রম্য লেখক, গবেষক, সিলেটের শ্রেষ্ঠ এক সন্তান সৈয়দ মোস্তফা কামাল।
Salim932@googlemail.com
23rd December 2013.London