Home » Featured » বিভিন্ন দল আর কোন্দলে বিভক্ত ব্রিটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটি, সম্ভাবনাসমূহ ধূলিসাৎ

বিভিন্ন দল আর কোন্দলে বিভক্ত ব্রিটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটি, সম্ভাবনাসমূহ ধূলিসাৎ

ব্রিটেনে এখন কয়েক লক্ষ বাংলাদেশীদের বসবাস। এক সময় ইন্ডিয়ান কারি রেস্টুরেন্টের একচ্ছত্র ব্যবসা আর মালিকানা ছিলো ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশীদের। কালের বিবর্তনে আর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন্স আর মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো থেকে দলে দলে লোক ব্রিটেন এসে বসবাস করতে শুরু করায় এই ব্যবসার অনেকটা এখন তাদেরও দখলে।তবে ঐতিহ্য, রান্নার মজা, রেসিপি, আর আতিথেয়তা ও সেবার মানের দিক থেকে বাঙালি এখনো এই কারি রাজ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলছে।

যার প্রমাণ বাঙালি কারি ব্যবসায়ী আমিন আলী, এনাম আলী আর বজলুর রশীদ, মাহতাব মিয়াদের মতো জনপ্রিয় ক্যাটারার এখনো ব্রিটেনের আনাচে-কানাচে সহ মেইনষ্ট্রীম ব্যবসায়ে ও রন্ধন পিয়াসু ও বিলাসীদের কাছে এক কিংবদন্তীতুল্য নাম। বিগত পাঁচ বছর সময়ে মারাত্মক আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানা সেক্টর ও কর্পোরেশন ক্রেডিটক্রাঞ্চের কবলে পড়লেও ব্রিটেনের বাঙালি মালিকানাধীন এই কারি ব্যবসা খুব একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি, উপরন্তু ট্রেজারিতে এই সাম্রাজ্য সিংহভাগ রাজস্ব যোগান দিয়ে ব্রিটিশ অর্থনীতির চাকাকে বেশ সচল ও বেগবান করে রেখেছে। যার ভূয়সী প্রশংসা হরহামেশাই কোন না কোন মওকা পেলেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে সহ অন্যরা করে থাকেন।

 

আজকের ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটি কারি ব্যবসার পাশাপাশি শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য নীতি, প্রশাসন সহ ব্যবসার নানা সেক্টরে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন মোবাইল টেকনোলজি সহ আধুনিক বিশ্বের নানা প্রযুক্তির বদৌলতে বিভিন্নমুখী ইনভেষ্টম্যান্ট ও ব্যবসায় অবদান রেখে চলেছে। এখনকার তরুণ প্রজন্মের ব্রিটিশ বাঙালিরা আর তাদের বাপ-দাদার প্রদর্শিত আদি কারি ব্যবসায় যেতে ইচ্ছুক নন। তারা এখন মডার্ন টেকনোলজি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডেন্টিস্ট, রাজনীতিবিদ, কাউন্সিলর, এমপি, মিডিয়া সহ নানান পেশায় পারদর্শী ও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। আর এই সব নানাবিধ সৃজনশীল পেশায় কারো কারো সাফল্য ব্রিটিশ মিডিয়া ও অনেকের কাছে ঈর্ষনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যেমন আছেন আমাদের ইকবাল আহমেদ এমবিই, ওয়ালী আহমেদ তছর উদ্দিন এমবিই, ফয়ছল চৌধুরী এমবিই, এনাম আলী এমবিই, শাহগীর বক্ত ফারুক, বজলুর রশীদ, ইনাম আলী, লুতফুর রহমান, আব্দাল আলী, ওহীদ উদ্দিন, রোশনারা আলী এমপি সহ আরো অনেকে।আমাদের তরুণ প্রজন্মের ব্রিটিশ বাঙালিদের আইন, মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং, শিপিং ক্যারিয়ারে সাফল্য আগামীর জন্য এক মাইল ফলক হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই। পূর্ব লন্ডন, মানচেস্টার, নিউক্যাসল, প্রভৃতি শহরে বেশ কিছু তরুণ-তরুণী ব্রিটিশ বাঙালি বেশ দাপটের সাথে ব্রিটিশ ও অন্যদের সাথে ক্যারিয়ার গড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, যা ব্রিটেনে বাঙালির আগামী দিনের ইতিহাসের গতিধারাকে নতুন দিকে ধাবিত করবে।

কিন্তু এতো সব সাফল্য ও উজ্জ্বলতার মধ্যে একরাশ হতাশা আর বেদনাদায়ক যে সংবাদ ব্রিটেন সহ তাবৎ বাঙালিকে আহত ও শঙ্কিত করে তুলে, আর তা হলো ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে ক্রম-বর্ধমান বিভেদ, হিংসা, হানা-হানি আর বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী, গোত্র আর উপদলে বিভক্ত হয়ে কমিউনিটিকে খন্ড-বিখন্ড করে তুলছে। আর এই বিভক্তির সুবাধে আমাদের নিজেদের মধ্যে যেমন একতা আর ঐক্যের মারাত্মক অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, একইসাথে মূলধারার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং পলিসি বাস্তবায়ন, প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র সমূহ থেকে ব্রিটেনের বাঙালিরা যেমন ছিটকে পড়তেছেন, সেই সাথে বিস্তর সম্ভাবনা থাকা সত্যেও পার্লামেন্ট ও মূলধারার রাজনীতিতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব পালনে ও গ্রহণে বন্ধাত্ম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মদের ভিতর থেকে যে শিক্ষিত মানবগোষ্ঠী ও নতুন সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব বেরিয়ে আসছে, আমাদের প্রতিনিয়ত কোন্দল আর দলা-দলির কারণে তাও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উপদল, আর রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে নানান সংগঠনের মধ্যে নানান কোন্দল ও দলাদলি আর গ্রুপের ফলে আমরা অন্যান্য ছোট ছোট কমিউনিটির চাইতেও মূলধারার রাজনীতি থেকে পিছিয়ে পড়েছি। অথচ আমাদের মধ্যে একতা থাকলে আমরা টাওয়ার হ্যামলেটস সহ ব্রিটেনের প্রধান প্রধান শহরের সব কটা কাউন্সিলের নির্বাহী সহ বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য এমপি, এমনকি লর্ড সভায়ও ইতিমধ্যেও পেয়ে যাওয়ার কথা, যা আমরা বঞ্চিত হচ্ছি, আমাদের বিভেদ আর কোন্দলের কারণে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নানান শাখা আর নানা সংগঠনের কোন্দলের রাজনীতির কারণে বিপুল সম্ভাবনা সত্যেও আমরা ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতিতে অনেক পিছনে পড়ে আছি। এই দিকে যেন আমাদের কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব আর রাজনৈতিক কোন্দল বাজদের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই।অনেক কষ্ট আর অনেকের ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে আমরা বিগত সাধারণ নির্বাচনে লেবার দল থেকে রোশনারা আলীকে এমপি হিসেবে পেয়েছি। অথচ আমাদের একটু খানি ঐক্য আর একটুখানি দেশাত্মবোধ হলেই আমরা লন্ডন সহ আশেপাশের বিভিন্ন আসন থেকে আরো কিছু সাংসদ সহজেই পেয়ে যাতে পারি। ব্রিটেনের কমিউনিটিতে এমন কিছু প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব আছেন, দেশের কোন্দলের রাজনীতিতে জড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ও জনপ্রিয়তাকে করে তুলেছেন প্রশ্নবিদ্ধ, অথচ এইসব ব্যক্তিত্ব ও নেতৃবৃন্দ যদি দেশের ঐ কোন্দল আর অযথা দলীয় হানাহানির রাজনীতি বর্জন করে ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতির সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতেন, তবে আমাদের কমিউনিটি আরো অনেক উপরে চলে যেতো সন্দেহ নেই।

বিগত সাধারণ নির্বাচনে টাওয়ার হ্যামলেটস বারাতে আমাদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য রোশনারার মতো তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বকেযখন সংসদে প্রেরণ করাতে ব্রিটিশ মিডিয়া সহ সর্বশ্রেণীর দৃষ্টি বাঙালি কমিউনিটির প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর কোয়ালিশন সরকারের বিপরীতে ব্রিটিশ সরকারের নানা নীতি নিয়ে রোশনারার প্রতিবাদ, প্রশ্ন ব্রিটিশ মিডিয়ায় ঝড় তুলে। যে কারণে গত বছর জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক টেলিগ্রাফ এর পর বহুল প্রচারিত ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড লিড নিউজে মন্তব্য করে বসে, ব্রিটেন অদূর ভবিষ্যতে কালো প্রধানমন্ত্রী পেয়ে যেতে পারে।

আমাদের চাইতে অনেক ছোট কমিউনিটি হয়েও অনেকেই তাদের প্রতিনিধি বড় বড় ক্ষেত্রে দখল করে আছে।তবে আশার কথা কেউ কেউ মাজে-মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে বাঙালি কমিউনিটির একতা ও ঐক্য নিয়ে আওয়াজ তুলেন, তা কেবল অন্ধকারে এক ঝলক আলোর হাতছানির মতোই। কমিউনিটির অনেক প্রবীণ, অভিজ্ঞ, বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব থাকা সত্যেও এব্যাপারে বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে এওয়ারনেস গড়ে তুলার জন্য পরিকল্পিতভাবে খুব একটা সোচ্চার বা কাজ করতে দেখা যায়নি।যখন কোন বিপদ এসে পড়ে পড়ে তখনি কেবল নিজেদের ঐক্য আর এক হয়ে চলার উপর তাগিদ আর আলোচনা সভায় খৈ ফুটিয়ে তুলেন। বিভিন্ন টক শো, মিডিয়া, সেমিনার বা সিম্পোজিয়ামে এই নিয়ে তেমন কোন কাজ কেউ করেছেন বলে দৃশ্যমান হয়নি, যতটুকু না সক্রিয় দেশের রাজনীতি আর দলীয় হানাহানি, আনুগত্য আর কোন্দল ও দলবাজিতে। তবে চ্যানেল এস-এর ফাউন্ডার চেয়ার মাহি বি চৌধুরী এব্যাপারে তার রিয়্যালিটি উইথ মাহি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিঞ্চিৎকরে হলেও কমিউনিটির মধ্যে এই ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা করেন, যে এই দেশের মূলধারার সাথে কি করে আরো বেশী সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের ভূমিকা রাখা যায়, সেই চেষ্টা করা উচিৎ সকলের। এর বাইরে তেমন কোন ভয়েস বা আওয়াজ শুনা যায়না।

নর্থাম্বরিয়ান ইউনিভার্সিটি, ডারহাম ইউনিভার্সিটি আর ফেইথ ফাউন্ডেশন ও আরো কিছু চ্যারিটি ব্রিটেনে বেড়ে উঠা বিভিন্ন তরুণ প্রজন্মের উপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, শতকরা ৯৬.০৯ ভাগ বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে দলবাজি, কোন্দল, হানাহানি তারা ঘৃণা করে। ৯৮% এর অভিমত এখানে হানাহানির মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি করে দলীয় রাজনীতির ঐ অন্ধ আনুগত্য চর্চা করার কোন মানে হয়না। এদের সাথে বিভিন্ন বয়সের ৯০% প্রবাসীও তাই মনে করেন। মাত্র ০.৩% মনে করেন দলীয় রাজনীতি করা উচিৎ, তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়।এই নগণ্য সংখ্যকের মধ্যে তারাও মনে করেন মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত কিভাবে হওয়া যায়, আমাদের কমিউনিটির সেদিকে ভূমিকা ও একটিভ হওয়া উচিৎ। নানা শ্রেণী ও পেশার ৮২% প্রবাসী মনে করেন, আমাদের অনৈক্য, গ্রুপিং, নেতৃত্বের দুর্বলতা আমাদেরকে মূলধারা থেকে পিছিয়ে রেখেছে।এর মধ্যে মজার ব্যাপার হলো ৩১% মহিলা মনে করেন, আমাদের সমাজের অনৈক্য, রাজনৈতিক বিদ্বেষ আর ব্রিটিশ সমাজ ও রাজনীতিতে ভূমিকা না রাখতে পারার কারণে অধিকাংশ মহিলা সম্ভাবনা থাকা সত্যেও নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

এনিয়ে কথা হয় লন্ডনের কমিউনিটির অতি পরিচিত মুখ, বিশিষ্ট কবি, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষক শামীম আজাদের সাথে।

 

প্রচণ্ড ব্যস্ত শামীম আজাদ। ফোন করতেই বললেন, সেলিম একটু ধরো, আমি আসছি। কিছুক্ষণ পরেই সহাস্যে বললেন, আমি প্রচন্ডভাবে একজন আশাবাদী মানুষ। আমি আশা করি নতুন প্রজন্ম কারো মুখের কথার উপর বিশ্বাস না করে নিজেদের উদ্যোগে গবেষণার মাধ্যমে বাংলা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির প্রকৃত ইতিহাসের সত্যানুসন্ধান করবে। আজকের যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। হাতের কাছেই সব তথ্য সহজেই পাওয়া যায়। দরকার কিছু উদ্যোগ, কিছু প্রেরণা, সঠিক মোটিভেশন। শামীম আজাদ আরো বলেন, ব্যক্তিগত অভিস্পা পূরণের জন্য একজন লোক সহজেই এই মাল্টি-কালচারাল সোসাইটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারে, এই সুযোগ সকলেরই সুন্দর ভাবে নেয়া উচিত। একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা, খাটি দেশপ্রেম, সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির প্রতি দরদ, মমত্ব কেবল পারে একজন তরুণ প্রজন্মকে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে, এখানে ঐকান্তিক চাওয়া আর একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতার কাছে ধর্ম, বর্ণ, বিভাজন, অনৈক্য, দলাদলি, হিংসা পরাভূত হতে বাধ্য। তিনি আরো বলেন, লোকাল ইস্যু কে লোকালি দেখে, সেটাকে গ্লোবালি ইস্যুর সাথে তুলনীয় না করে বরং গ্লোবাল মেকানিজম আর কনসেপ্ট এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের প্রজন্মকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। কেননা নিজেদের মধ্যে অনৈক্য, হানাহানি ম্লান করে দেয় আমাদের অনেক সুন্দর অর্জন সমূহকে। তাই সকলকে এবিষয়ে সচেতন হওয়ার তাগিদ দিলেন শামীম আজাদ।

salim932@googlemail.com
26th June 2013.UK

Please follow and like us:
Pin Share

Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Follow by Email
YouTube
Pinterest
LinkedIn
Share
Instagram
error: Content is protected !!