শহীদ বেদীতে উৎসব নয়- চাই নিরবতা এবং আলতাব আলীর পরিবারের প্রতি করণীয়
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ- লন্ডন থেকে
একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস। আমরাই একমাত্র জাতি , যারা ভাষার জন্য বুকের রক্ত ডেলে দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি আদায় শুধু নয়, এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালির স্বাধীনতার যে বীজ মন্ত্র লুকায়িত ছিলো- তারই ফলে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছি। আমরা ইতিহাসের গতিপথকে নতুন করে নির্ধারণ করে দিয়ে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছি- বাঙালি পরাভব মানেনা। একুশ এমন এক শক্তি- যা আমাদেরকে সকল সময় সকল অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি ও সাহস যোগায়। এই একুশ কোন প্রজন্মকে জন্ম দেয়নি- বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মতরে, কালের পর কালান্তরে বার বার ফিরে আসে বাঙালির কোলে, মননে, হ্রদয়ে এই একুশ। একটি ভাষা, ভাষার জন্য সংগ্রাম- কোন জাতিকে এমন উচ্চতায় নিইয়ে যেতে পারে- বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম না দেখলে পৃথিবী কোনভাবেই অবগত হতে পারতোনা। আজকের পৃথিবী তাই বাঙালির প্রাণের এই একুশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার রূপ পরিগ্রহই শুধু লাভ করেনি, বরং আজকের শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে তাই একুশের এই সার্বজনীনতায় মুগ্ধ হয়ে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য বিল উত্থাপন করেছেন বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে।
বাঙালির এই একুশ এখন আর নিজ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, পদ্মা-মেঘনা, যমুনা, ভাগীরথী, সুরমার পার ছুঁয়ে এখন টেমসের ওপারে বিশ্ব বাঙালি সহ সকল সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে উৎসুক যেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে, নানা সম্প্রদায়ের, নানা ভাষার, ভিনদেশীদের মধ্যেও স্বপ্ন সাহস ও শক্তি যোগাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন সমগ্রতার মধ্য দিয়ে নিজেকে তুলে ধরেছেন, নজরুল ইসলামও তেমনি এপার বাংলায় সমগ্রতার ভিতরে নিজেকে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি। ঠিক তেমনি বাঙালির বায়ান্নর একুশ মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্য বিত্ত, উচ্চ মধ্য বিত্ত, উচ্চ শ্রেণী সহ সর্বস্তরের জনগনের মধ্যেই বিকশিত যেমন হয়, নিজেকে প্রতিটি বছরে নতুন নতুন করে তুলে ধরে অফুরান শক্তির এক আধার হিসেবে। লন্ডনের প্রবাসী বাঙালিরা এক সময় যে হুগলীর বন্দর হয়ে এই বিলেতে এসে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিজেকে কাজের উপযুক্ত হিসেবে তুলে ধরার জন্য নয়, প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তারাও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন কালক্রমে একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করে। না হলে এক সময় যে ইষ্ট ইন্ডিয়া বেনিয়া কোম্পানি ভারত বর্ষ শাসন করলো, সেই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেশে কাজের সন্ধানে আসা বাঙালি এখন একুশের চেতনায় শাসন কর্তা হয়ে যাচ্ছে। এই পাওয়া কিন্তু কম অর্জন নয়। শাসন কর্তা বনে যাচ্ছে বলেই এক সময় যে টাওয়ার হ্যামলেটসে আলতাব আলী পার্কের মধ্যে সিলেটের ছাতকের আলতাব আলীকে শ্বেতাঙ্গরা কালো আলতাব আলীকে পিঠিয়ে হত্যা করেছিলো- সেই পার্কেই বাঙালি তাদের শক্তির উৎস একুশের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শহীদ মিনার শুধু স্থাপন করেনি, আলতাব আলীর স্মরণে পার্কের নামকরণ শুরুতেই করে নতুন এক শক্তির সূচনা করে। বছর ঘুরে যখন একুশ আসে তখনি বাঙালি ছেলে বুড়ো শিশু সবাই রাত ১২টা ০১ মিনিটে দল বেধে ছুটে আসে এই আলতাব আলী পার্কে। এবারের একুশের প্রথম প্রহরে আলতাব আলী পার্কের এই শহীদ মিনারে একে একে ফুল দিতে আসে বাংলাদেশের হাই কমিশনার মোহাম্মদ হান্নান, যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বেতার বাংলা ১৫০৩, ইতালী প্রবাসী অয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন, স্বেচ্ছাসেবক দল, তরুণলীগ, প্রজন্মলীগ সহ নানা সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠন সমূহ। বেতার বাংলা আলতাব আলী পার্ক থেকে একুশের প্রথম প্রহরের সকল অনুষ্ঠানমালা লাইভ সম্প্রচার করে- যা ছিলো সকলের কাছে আকর্ষণীয়। এতোসব শক্তির আধার ও সফলতা ম্লান করে দেয় যখন দেখি, শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ছেলে বুড়ো সকলেই, উদ্যোক্তা, রাজনৈতিক নেতা- কর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সকলেই ফুল দিতে গিয়ে হৈ হুল্লোড় আর ছবি তুলার আনন্দ উৎসবে মেতে উঠি- যা একুশের চেতনা ও শক্তির সাথে বেমানান। শহীদ বেদীতে উৎসব ও হৈ হুল্লুড় নয়, শ্রদ্ধা ভালোবাসায় নিরবতাই কাম্য। কেননা এদিন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো ঢাকার রাজপথ। তাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের মাতৃভাষা।
আর যে সত্য কথাটি না বললেই নয়, যে আলতাব আলীর জীবনের বিনিময়ে আমরা শহীদ আলতাব আলী পার্ক পেয়েছি, এই আলতাব আলী পার্কে বাংলাদেশের বাইরে প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ের, লন্ডনের স্থাপত্যপনার নিদর্শন শহীদ মিনার প্রতিষ্টিত হয়ে আছে, সেই আলতাব আলীর পরিবার বর্তমানে সিলেটের ছাতকে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন। লন্ডন প্রবাসী বাঙালি আর বাংলাদেশের লাখো কোটি জনতা সেই সাথে সরকার আলতাব আলীর পরিবারের প্রতি মানবিক সাহায্য নিইয়ে এগিয়ে আসবেন- এমন আশাই করি আজকের এই একুশের দিনে।
21st February 2015, London